পৃথ্বীশরাজ কুন্তী : কখনো মরণোত্তর চক্ষুদান বা দেহদানের বার্তা নিয়ে সাইকেল নিয়ে, আবার কখনো বা বাইকে ভারতের বিভিন্ন শহরে পাড়ি দিয়েছেন। করোনা আবহে দাঁড়িয়ে অতিমারী সম্পর্কে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের মধ্যে সচেতনতার বার্তা পৌঁছে দিতে এবার পা’য়ে হেঁটেই দেশ ভ্রমণ সম্পন্ন করলেন গ্রামীণ হাওড়ার উদয়নারায়ণপুর ব্লকের সিংটীর বাসিন্দা ঠাকুরদাস শাসমল। শুনতে বিস্ময়কর মনে হলেও তা-ই করে দেখিয়েছেন সকলের প্রিয় ‘দাসুদা’। গত ২৪ শে আগস্ট বর্ধমানের উল্লাস মোড় থেকে ২ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে হাঁটা শুরু করেছিলেন।
তারপর ঝাড়খন্ড, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি, রাজস্থান, গুজরাট, মুম্বাই, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, চেন্নাই সহ দেশের বিভিন্ন রাজ্য ও শহর ঘুরে আজ ১ লা ডিসেম্বর পৌঁছে গিয়েছেন উলুবেড়িয়ায়। ইতিমধ্যেই পা’য়ে হেঁটে প্রায় ছ’হাজার কিমি পথ অতিক্রম করেছেন। বাকি আর আড়াইশো কিমি। মঙ্গলবারই পা রাখবেন বাংলার রাজধানী শহরে। তবে এখানেই শেষ নয়। যেহেতু বর্ধমানের উল্লাস মোড় থেকে নিজের যাত্রা শুরু করেছিলেন পেশায় ভাগচাষী দাসুদা, তাই সেখানে গিয়েই দীর্ঘ প্রায় ১০০ দিনের যাত্রা শেষ করবেন উদয়নারায়ণপুরের এই প্রৌঢ়। ছোটো থেকেই ঘোরার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতেন ঠাকুরদাস।
আর্থিক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও স্বপ্ন দেখতে দেশ ভ্রমণের। সেই নেশা মেটাতেই হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে একটি বাইক কেনেন ঠাকুরদাস। তা নিয়েই মাঝেমধ্যেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মাঝেমধ্যেই বেড়িয়ে যেতেন। ২০০৩ সালে ঠাকুরদাস বাবু ‘ভিলেজ বাইকার্স’ নামক একটি সংগঠনও গড়ে তোলান। গত ২০১৮ সালে সাইকেলের প্যাডেলে পা রেখেই পৌঁছে গিয়েছিলেন ভারতের বিভিন্ন শহরে। সেবার লক্ষ্য ছিল মরণোত্তর চক্ষু ও দেহদান সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা। তবে এবার পায়ে হেঁটেই পৌঁছে গেলেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। ঠাকুরদাসের এবারের সঙ্গী ছিলেন দিনমজুর মনোজ মান্না ও একটি সাইকেল। মনোজ সাইকেলে জিনিসপত্র চাপিয়ে নিতেন। ঘড়ির কাঁটায় রাত দুটো বাজলেই শুরু হত তাঁদের পথচলা।
চড়াই-উতরাই পথ, কখনো বা জঙ্গল কিমবা মালভূমি সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে পিছনে ফেলে নিজেদের স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে ছোট্ট ছোট্ট পায়ে এগিয়ে যেতেন। সারাদিনের শেষে সূর্য যখন অস্তাচলে তখন বন্ধ হত তাঁদের হাঁটা। সঙ্গে থাকা অস্থায়ী ছাউনি খুলে রাস্তার পাশে আশ্রয় নিতেন ঠাকুরদাস ও মনোজ। রান্নার জন্য ছিল পোর্টেবল সিলেন্ডার। চাল-ডাল ফুটিয়ে খেতেন। আর রাস্তার পাশে পেট্রোলপাম্প কিমবা সরাইখানা পেলে সেখানেই শৌচকৃত্য সেরে নিতেন। এই সুদীর্ঘ চলার পথে নানা সমস্যারও সম্মুখীন হয়েছেন দাসুদা। কখনো জুতো ছিঁড়েছে আবার কখনো বা পা কেটে রক্ত ঝড়েছে। তখনই পাশে দাঁড়িয়েছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাইকার্স কমিউনিটির সদস্যরা।
কেউ কিনে দিয়েছেন জুতো, কেউ লাইট, জ্যাকেট কেউ আবার সাইকেল সারিয়ে দিয়েছেন। আর তাঁর এই স্বপ্নপূরণে অন্যতম সাথী হয়েছে ‘ভিলেজ বাইকার্স’-এর সদস্যরা। সংগঠনের সদস্যরা জানান, ঠাকুরদাস অত্যন্ত সহজ,সরল, ছাপোষা মানুষ। তাঁর এটিএম কার্ড অব্ধি নেই। তাই আমরাই তাঁকে এটিএম কার্ড বানিয়ে সময়ে সময়ে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করেছি। স্বপ্ন জয় করে ফেরার পথে ঠাকুরদাস শাসমল জানান, “করোনা সচেতনতায় এই অভিযান। সাথে মনোজ না থাকলে এই বয়সে এতটা পথ একা পাড়ি দিতে পারতাম না।” তাঁর কথায়, “প্রতিদিন প্রায় ১৬ ঘন্টা করে হেঁটেছি। গোটা ভারতে অসংখ্য বাইকার্স আমাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। কোথাও কোনো তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়নি।” ঘরের ছেলে দেশভ্রমণ করে ফিরছেন। আর তাঁকে অভিনন্দন জানাতে প্রস্তুত উদয়নারায়ণপুর।