সুপ্রাচীন ঝাঁপকে কেন্দ্র করে মেতে ওঠে শ্যামপুরের গ্রাম, থাকে কালিকাপাতাড়ি নাচ, বিভিন্ন প্রথা

By নিজস্ব সংবাদদাতা

Published on:

পৃথ্বীশরাজ কুন্তী : প্রায় ছ’শো বছর আগের কথা। শ্যামপুরের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে দামোদর। জনশ্রুতি, নদীপথে ব্যবসা করতে যাওয়ার সময় বণিক চাঁদ সদাগর বর্ধমানের মহারাজা বিজয় চাঁদের উদ্যোগে শ্যামপুরের রতনপুর গ্রামে ‘রত্নমালা’ দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।

এই রত্নমালা মন্দিরের কয়েক’শো বছরের প্রাচীন ঝাঁপ ও গাজন উৎসবকে ঘিরে প্রতিবছরের মতো এবছরও মেতে উঠেছে শ্যামপুর-২ ব্লকের আমড়দহ অঞ্চলের রতনপুর গ্রাম। চিরাচরিত রীতি মেনে, চৈত্র‍সংক্রান্তির পাঁচদিন আগে থেকেই গাজন উৎসব শুরু হয়েছে রতনপুরে। উদ্যোক্তারা জানান, চৈত্র‍ সংক্রান্তির আগের দিন থেকে মূল উৎসবের শুরু।

নীলরাত্রিতে সাড়ম্বরে নীলের বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। নীলের বিয়ের আসরকে মাতাতে দীর্ঘ কয়েক দশকের রীতি মেনে ভোরে অনুষ্ঠিত হয় হাওড়া জেলার নিজস্ব লোকনৃত্য কালিকাপাতাড়ি। রতনপুর রত্নমালা কালিকাপাতাড়ি নৃত্য সংস্থার জ’না পনেরো কুশীলবরাই কালিকাপাতাড়ি নৃত্য প্রদর্শন করেন। নীলষষ্ঠী থেকেই কাতারে কাতারে মানুষের ভিড় উপচে পড়ে রত্নমালা মন্দির প্রাঙ্গণে।

পরের দিন অর্থাৎ চৈত্র‍ সংক্রান্তির দিন ‘রত্নমালা’র প্রসিদ্ধ ঝাঁপ অনুষ্ঠিত হয়। সে ঝাঁপও রীতিমতো দেখার মতো। স্থানীয়দের দাবি, এটি বর্তমানে এই অঞ্চলের সর্বোচ্চ ঝাঁপ। জানা যায়, আগে ৬৫-৭০ ফুট উঁচু থেকে ঝাঁপ পড়লেও কয়েক বছর আগে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ায় সেই উচ্চতা কমিয়ে ২৫-৩০ ফুটে নামানো হয়েছে। কালের নিয়মে ঝাঁপে অংশগ্রহণকারী পুণ্যার্থীর সংখ্যাও বেশ কিছুটা কমেছে। আগে ১৫-২০ জন ঝাঁপ পড়লেও এখন ৩-৪ জন পড়েন।

কিন্তু, সাড়ম্বরে ঘাটতি নেই এই সুপ্রাচীন গাজন উৎসবের। সু-প্রাচীন ঝাঁপান উৎসবকে ঘিরে বহু মিথ ও জনশ্রুতিও প্রচলিত রয়েছে স্থানীয় এলাকায়। শোনা যায়, এখানে একটি পুরানো নারকেল গাছ রয়েছে। তার সমান ঝাঁপ বাঁধানো হয়। মা ফুল ফেললে তবেই নাকি ঝাঁপ হয়। ঝাঁপের সময় চিল উড়লে তবেই নাকি ঝাঁপ পড়ার রীতি প্রচলিত আছে বলে জানা যায়।

রত্নমালা মন্দিরের পূর্বতন পূজারী নরোত্তম রায় মন্দিরের ইতিহাস ব্যাখা করতে গিয়ে বলেন, “এক পূজারী তাঁর রতন নামক মেয়েকে লাল পাড় শাড়ি পরিয়ে দেবীর কাছে পুজো দিতে আসেন। পুজো দেওয়ার আগে ছোট্ট মেয়েটিকে মন্দিরে বসিয়ে পূজারী মন্দির লাগোয়া পুকুরে হাত-পা ধুতে যান। কিন্তু, মন্দিরে ফিরে আর মেয়েকে দেখতে পাননি তিনি। চারিদিক খোঁজাখুজি করার পরে তিনি মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত মাতৃমূর্তির মুখে তাঁর মেয়ের পরনের শাড়ির আঁচল দেখতে পান। পূজারির ধারণা হয়, মা তাঁর মেয়েকে নিয়ে নিয়েছেন। তারপর থেকেই রতনপুর গ্রামের ওই মাতৃমূর্তি ‘রত্নমালা’ দেবী হিসেবে পরিচিত হন।”

তিনি আরও জানান,”কথিত আছে, চাঁদ সদাগর বাণিজ্য করতে যাওয়ার সময় এখানে দামামা (বিশেষ বাদ্যযন্ত্র) দিয়ে গিয়েছিলেন। তা দিয়ে সকাল-সন্ধ্যা নিয়মিত ‘নিশান’ দেওয়া হয়। এই জনপ্রিয় গাজন উৎসবের কথা বলতে গিয়ে কার্যত আবেগবিহ্বল হয়ে পড়েন বছর চৌষট্টির নরোত্তম বাবু। তিনি বলেন,”এযে কত পুরানো তা বলা খুব মুশকিল। আমার বাপ-ঠাকুরদারাও তাঁদের পূর্বপুরুষদের মুখে এই উৎসবের কথা শুনেছেন।”

নরোত্তম বাবুতো বটেই নবীন প্রজন্মের মধ্যেও এই সু-প্রাচীন উৎসবকে ঘিরে কৌতুহল কিমবা উদ্দীপনার শেষ নেই। এলাকার শিক্ষক আশীষ মন্ডলের কথায়, “শ্যামপুরের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় রতনপুরের ঝাঁপ৷ বহু উঁচু থেকে ঝাঁপ পড়ার জন্য এই ঝাঁপের খ্যাতি জেলাজুড়ে। ছোটো থেকে বহু স্মৃতি জড়িয়ে। এখনো প্রতিবছর আসি।”

কালের নিয়মে ঐতিহ্য, কিমবা আয়োজনে কিছুটা ভাটা পড়লেও বা ‘হাকুন্দ’ বা বাণমারা প্রথা বন্ধ হলেও আজও হাজার-হাজার মানুষের উপস্থিতিতে কালিকাপাতাড়ির নৃত্যছন্দে ঝাঁপান উৎসবে বছরশেষে মেতে ওঠে রতনপুরের রত্নমালা মন্দির প্রাঙ্গণ।