নিজস্ব সংবাদদাতা : কোনোটায় ফুটে উঠেছে রাম-রাবণের কাহিনী,আবার কোনোটায় ভেসে উঠছে বাংলার অনন্যসাধারণ গ্রামীণ প্রাকৃতিক শোভা বা নিত্য জীবনের কোলাজ,অথবা বিভিন্ন মহাপুরুষদের চিত্র।এযেন একটুকরো বর্ণময় ক্যানভাস।বাংলা তথা বাঙালি জীবনের এক অনবদ্য অঙ্গ নকশীকাঁথা।’নকশী কাঁথাটি বিছাইয়া সাজু সারা রাত আঁকে ছবি,ও যেন তাহার গোপন ব্যথার বিরহিয়া এক কবি’—নকশীকাঁথার কথা মনে এলেই ভেসে ওঠে কবি জসীমউদ্দিনের সেই দু’ই বিখ্যাত চরিত্র—রূপাই ও সাজু।রূপাইয়ের সাথে মিলন থেকে বিচ্ছেদের সমস্ত কাহিনী সাজু তুলে রেখেছিল নকশীকাঁথার বুকে।কাঁথা পল্লীবাংলার মেয়েদের আত্মপ্রকাশের মাধ্যম,না বলা অন্তরঙ্গ কথা তোলা থাকে এই এক টুকরো কাপড়ের প্রতি বিন্দুতে।নানাবিধ ফোঁড় তুলে ধরে কাঁথার ভাষা।
![](http://www.uluberiasambad.in/wp-content/uploads/2020/02/4-16.jpg)
বাংলায় কাঁথা বুননের রীতি বহুকাল থেকেই প্রচলিত।যদিও কবি জসীমউদ্দিনের হাত ধরেই ‘নকশীকাঁথা’ শব্দের প্রচলন হয় তৎকালীন অবিভক্ত বঙ্গে।নকশীকাঁথা বাংলার লোক ও কারু শিল্পের অন্যতম ঐতিহ্যমন্ডিত ও নান্দনিক নিদর্শন।শীতের হাল্কা রোদে বাড়ির উঠোনে বসে একের পর এক এরকমই স্বপ্ন বুনছেন শ্যামপুর থানার প্রতাপপুর গ্রামের গৃহবধূ পুরবী রায়।নাহ,পেটের টানে বা পেশার তাগিদে নয়;সম্পূর্ণরূপে শিল্পকে ভালোবেসে শিল্পীর ক্যানভাসে ভেসে ওঠে নানাবিধ শিল্পকর্ম।অনুপম শৈল্পিক দক্ষতায় কাঁথার জমিনে এই মধ্যবয়স্কা শিল্পী ফুটিয়ে তুলছেন গাছ,পাখি কিমবা লতাপাতার ছবি।কোনোসময় তাঁর তৈরি কাঁথায় উঠে এসেছে দুঃখ-সুখের কাহিনী,কখনো লন্ঠনের নিভু আলোয় শোনা পুঁথির গল্পই সূচ দিয়ে কাঁথায় ফুটিয়ে তুলেছেন বছর পঞ্চাশের এই গৃহবধূ।চশমা চোখে কাঁথা বুনতে বুনতে পুরবী দেবী মৃদুস্বরে জানান,”একবিংশ শতকের বিজ্ঞানের এই যুগে দাঁড়িয়ে কাঁথার জৌলুস অনেকটাই ম্লান হয়েছে।
![](http://www.uluberiasambad.in/wp-content/uploads/2020/02/2-24.jpg)
তবুও বাংলার বেশ কিছু প্রত্যন্ত গ্রামের বাড়িতে শিশু জন্ম নেওয়ার সময় কাঁথা তৈরির রেওয়াজ আজও আছে।কিমবা বিয়েবাড়িতে বা অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানেও নকশীকাঁথা উপহার হিসেবে দেওয়ার রীতি আছে।”১৯৮৬ সাল থেকে কাঁথাবোনার কাজ করছেন তিনি।বেলুড় শিল্পমন্দির থেকে কাঁথাশিল্পের উপর বিশেষ প্রশিক্ষণও নিয়েছেন পুরবীদেবী।তাঁর তৈরি কাঁথা দেশের বিভিন্ন মিউজিয়ামে স্থান পেয়েছে,এমনকি প্রদর্শিত হয়েছে বিভিন্ন বড়ো মেলা ও প্রদর্শনীতেও।তাঁর কথায়,”আজকাল লোকসংস্কৃতির অন্যতম অঙ্গ নকশীকাঁথা ভারতীয় জনসমাজে বর্তমানে সেভাবে সমাদৃত না হলেও,বাংলাদেশে এখনো বেশ প্রচলন আছে এই লোকশিল্প।”তিনি ব্যক্তিগতভাবে বহু মানুষকে তাঁর শিল্পকর্ম উপহার হিসেবে দেন।কেউ আবার আব্দার করেন একখানা নকশী কাঁথা বুনে দেওয়ার জন্য।এক একটি কাঁথা বুনতে প্রায় ৬-৭ মাস সময় লাগে।ভারী কাজ হলে লাগে প্রায় ১ বছর।প্রথমে তিনি কাগজের উপর ছবি আঁকেন।তারপর তা কাপড়ের উপর ছেপে নেন।তারপর শুরু হয় বুননের কাজ।কখনো এমব্রয়ডারি স্টিচ,কখনো গুজরাটি বা পাঞ্জাবি স্টিচ দেন।এভাবেই কাপড়ের উপর নিজের ভাবনা ও অনুপম শিল্পকর্মের প্রতিফলন ঘটান হাসি মুখের এই সহজ-সরল মানুষটি।
![](http://www.uluberiasambad.in/wp-content/uploads/2020/02/3-24.jpg)
পুরবী দেবী জানান,ব্যবসায়িক স্বার্থে তাঁর কাজ নয়।তাঁর কাজ অপরকে আনন্দদানের জন্য।হারিয়ে যেতে বসা শিল্পকর্মকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য।এক একটি কাঁথা তৈরিতে প্রচুর মজুরির প্রয়োজন হয়।কিন্তু,স্বামী অবসর নেওয়ার পর সংসারের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যও অনেকটা বিলীন হয়েছে।তাই বাইরে থেকে কাউকে রাখতে পারেন না।তাই একা হাতেই দীর্ঘ সময় ধরে কাঁথা বোনেন।পুরবীদেবীর আক্ষেপ, “একাধিকবার স্থানীয় পঞ্চায়েত ও বিডিওকে জানিয়েও মেলেনি কোনো সাহায্য”। তবে সরকারিস্তরে কোনো সাহায্য মিললে তাঁর গ্রাম প্রতাপপুরকে দেশ-বিদেশের বুকে নিজ শিল্পকর্মের মধ্য দিয়ে তুলে ধরতে অত্যন্ত আগ্রহী বলেও তিনি জানান।সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে দাঁড়িয়ে বাঙালির মনন থেকে ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছে বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি।বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতীকগুলির কথা আজ যেন রূপকথার গল্পের মতো শোনাতে হয় আমাদের নতুন প্রজন্মকে।হয়তো বা আগামী প্রজন্মের কাছেও ইতিহাস হয়ে যাবে গ্রাম বাংলার ধূলিধূসরিত এই সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যগুলো।হয়তো কোনও যাদুঘরের দেওয়ালে ঠাঁই নেবে প্রাচীনের সন্ধানে পথে নামা কোনও দলছুট বাঙালির স্মৃতি রোমন্থনের জন্য।তা-ই বাংলার গৌরবময় সুস্থ সংস্কৃতি,শিল্প,ঐতিহ্যের ধারাকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রাণপণে নিঃস্বার্থভাবে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন পুরবী দেবীর মতো নির্ভেজাল মাটির মানুষগুলো।