আর্তের সেবায় নিবেদিত প্রাণ, চার দশক ধরে মানুষের সেবা করে চলেছেন শ্যামপুরের গ্যাস্টন দা

By নিজস্ব সংবাদদাতা

Published on:

বিশেষ প্রতিবেদন : প্রখ্যাত ফরাসি লেখক ডোমিনিক ল্যাপেয়ারের লেখা বিখ্যাত উপন্যাস ‘সিটি অফ জয়’এর কথা মনে পড়লেই প্রথম মাথায় আসে কেন্দ্রীয় চরিত্র ফাদার কোভালস্কির কথা। একজন চিকিৎসক যিনি নিজেকে নিবেদিত করেছিলেন আর্তের সেবায়। হয়ে উঠেছিলেন আর্ত, পীড়িত মানুষের ভগবান। আর ডোমিনিক ল্যাপেয়ারকে ‘সিটি অফ জয়’ লিখতে কিমবা ফাদার কোভালস্কির চরিত্র সৃষ্টি করতে যিনি অনুপ্রাণিত করেছিলেন তিনি ব্রাদার গ্যাস্টন দয়ানন্দ, সকলের প্রিয় গ্যাস্টন দা। আসলে রক্তমাংসের ব্রাদার গ্যাস্টন দয়ানন্দই ‘সিটি অব জয়’এর ফাদার কোভালস্কি। বিস্তারিত জানতে নীচে পড়ুন…

গ্রামীণ হাওড়ার শ্যামপুরের গোহালপোতা গ্রামে গান্ধীভবনে দেখা মিলবে গ্যাস্টন দা’র। ইটের দেওয়াল আর খড়ের ছাউনির ‘গান্ধীভবন’ই এখন তাঁর বাসস্থান। মানবসেবার টানে সুদূর ইউরোপ থেকে এদেশে এসেছিলেন। আর ফেরা হয়নি। এখানেই মন পড়ে গেছে গ্যাস্টন দা’র। সুইজারল্যান্ডের জেনিভায় ব্রাদার গ্যাস্টন দয়ানন্দের জন্ম। সেখানেই বেড়ে ওঠা। ছোটো থেকেই মানবদরদী মন। তাই মানুষের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়া। মানব সেবার টানে ছুটে যান ফ্রান্স। তারপর ভারত। সালটা ১৯৭২।

বাংলা, বিহারের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে কাজ শুরু করেন। কখনো ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্তকে সেবা করা আবার কখনো বা বন্যা কবলিত মানুষকে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া আবার বা বঞ্চিত মানুষকে নতুন করে স্বপ্ন দেখানো — এভাবেই চলে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর লড়াই। হাওড়ার পিলখানায় কাজ করার সময় মানুষের সাথে মিশে যান গ্যাস্টন দা। তা-ই এখানেই পাকাপাকিভাবে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন। পরবর্তীকালে ভারতের নাগরিকত্বও গ্রহণ করেন। পিলখানাতে থাকাকালীন ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত মানুষের সেবা – সুশ্রুষার কাজ শুরু করে দিলেন। ১৯৭৮ সালের বন্যায় আমতা, উলুবেড়িয়া, বাগনান, উদয়নারায়ণপুর সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নৌকা করে ত্রাণ এনে মানুষকে পৌঁছে দিয়েছিলেন ব্রাদার গ্যাস্টন দয়ানন্দ। তারপর সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের মানুষের জন্য কাজ শুরু। আর এভাবেই চার দশকেরও বেশি সময় ধরে মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন গ্যাস্টন দা।

শ্যামপুরের গোহালপোতা গ্রামে তিনি তৈরি করেছেন ‘ইন্টার রিলিজিয়াস সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট’ বা ‘আইকড’ নামক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। শান্তিনিকেতনি ভাবনায় গোহালপোতায় প্রায় বত্রিশ বিঘা জমির উপর গড়ে উঠেছে আইকডের বিভিন্ন কর্মকান্ড। বৃদ্ধাশ্রম, অনাথ আশ্রম, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের বিশেষ আবাসস্থল, পোল্ট্রি ফার্ম, অজস্র দেশি-বিদেশি গাছ সহ আরও কত কী! আইকডের আশ্রয়স্থলে স্থান পেয়েছে ক’য়েকশো আশ্রয়হীন অসহায় শিশু, কিশোর, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। এসব নিয়েই সুশোভিত আইকডের ক্যাম্পাস।

সেই ক্যাম্পাসের এক চিলতে কুঁড়ে ঘরেই থাকেন বছর ছিয়াশির ব্রাদার গ্যাস্টন দয়ানন্দ। শরীরে বার্ধ্যকের ছাপ। কিন্তু মনে তাঁর অসম্ভব জোর। আর সেই অদম্য মানসিক শক্তিকে সম্বল করেই হুইল চেয়ারে বসেই নিজের বৃহৎ কর্মকান্ডের স্থল ঘুরে দেখেন। দশকের পর দশক জুড়ে তিনি কেবল আর্তের সেবাই করেননি, সুকেশী বাড়ুই, জন মেরি বাড়ুই, এম এ ওয়াহাব, সাবিত্রী পাল, গোপা ঘোষদের মতো তিনি তাঁর যোগ্য উত্তরসূরীদের তৈরি করেছেন যাঁরা আজ অজস্র অসহায় মানুষকে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। সকলের প্রিয় গ্যাস্টন দা আজীবন অকৃতদার থেকে এভাবেই গেয়ে চলেছেন মানুষের জয়গান — ‘সবার উপর মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই’।