বাংলার ‘মুখোশ’ গ্রাম

By নিজস্ব সংবাদদাতা

Published on:

পৃথ্বীশরাজ কুন্তী : শিল্প ও সংস্কৃতিতে বিশ্বজুড়ে বাংলার খ্যাতি সুবিদিত। বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের বহু হস্ত ও কুটিরশিল্প গ্রাম বাংলার অন্যতম সম্পদ। সময়ের স্রোতে বাংলার বুক থেকে অনেক শিল্পকর্মই ক্রমে লুপ্ত হতে বসেছে। যে সমস্ত লোকশিল্প এখনো তার গরিমা ও ঐতিহ্যকে সম্বল করে বাংলা বুকে বর্তমান তার মধ্যে অন্যতম ছৌ-নাচ। ছৌ-নাচের খ্যাতির সীমানা দেশ ছাড়িয়ে বিশ্বের দরবারে ইতিমধ্যেই বিশ্বের দরবারে পৌঁছে গিয়েছে। আর ছৌ-নাচকে কেন্দ্র করেই বাংলার বুকে গড়ে উঠেছে এক শিল্পগ্রাম, যা বর্তমানে ‘মুখোশ’ গ্রাম হিসাবে লোকমুখে বাংলার পর্যটন মানচিত্রে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। পুরুলিয়া জেলার অযোধ্যা পর্যটন সার্কিটের বাঘমুন্ডির অনতিদূরে পাহাড়ি ঢালে অবস্থান করছে চড়িদা নামক গ্রাম। গ্রামে প্রায় চারশো পরিবারের বসবাস। সকাল থেকে রাত অব্ধি গ্রামের প্রায় প্রত্যেকটা মানুষ শিল্পকর্মের সাথে নিযুক্ত থাকেন। চড়িদা গ্রামেই তৈরি হয় ছৌ-নাচের বিখ্যাত মুখোশ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাংলা, ঝাড়খন্ড ও ওডিশার বিভিন্ন এলাকায় ছৌ-নাচ ভীষণভাবে জনপ্রিয়। বিভিন্ন লোকগাথাকে অবলম্বন করে ছৌ-নাচের পালা উপস্থাপন করা হয়। প্রত্যেক পালার জন্য বিভিন্ন মুখোশের প্রয়োজন হয়। সেই মুখোশ তৈরির কাজেই বংশপরম্পরায় নিয়োজিত রয়েছেন চড়িদা গ্রামের মানুষজন। ছৌ-নাচের শিল্পীরা চড়িদা গ্রামে এসেই মুখোশ কিনে নিয়ে যান। বাঘমুন্ডি থেকে উঁচুনীচু পাহাড়ের বুক চিড়ে চলে গিয়েছে ঝালদাগামী রাস্তা। বিস্তারিত জানতে নিচে আরোও পড়ুন…..

সেই রাস্তার ধারেই চড়িদা গ্রাম। রাস্তার দু’ধার বরাবর প্রায় শ’খানেক দোকান। সকাল থেকেই দোকানে দোকানে ব্যস্ততার ছবি। কেউ কাগজের কাজে ব্যস্ত, কেউবা মাটি লেপার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে আবার কেউ পুতি ও পালক দিয়ে মুখোশ তৈরিতে মগ্ন। আট থেকে আশি সকলেই এই শিল্পের সাথে যুক্ত। সময়ের সাথে সাথে অন্যান্য লোকশিল্পের চাহিদায় ভাটা পড়লেও চড়িদা গ্রামের মুখোশ তৈরির এই শিল্পকর্ম ক্রমাগত খ্যাতি লাভ করে চলেছে। বছরভর বহু মানুষ চড়িদা গ্রামে আসেন। বিভিন্ন দোকান ঘুরে নানা মুখোশ সংগ্রহ করেন। শিল্পীদের সাথে কথা বলতে গিয়ে জানা যায়, বর্তমানে মুখোশের চাহিদা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ, বহু মানুষ ঘর সাজানোর সামগ্রী হিসাবে মুখোশ ব্যবহার করছেন। ফলে চড়িদার মুখোশের চাহিদাও বাড়ছে। পাশাপাশি, বর্তমানে বিভিন্ন পুজো প্যান্ডেলেও এই মুখোশ ব্যবহার করা হচ্ছে। এমনকি বিভিন্ন চলচ্চিত্রেও চড়িদার মুখোশ ব্যবহার করা হচ্ছে। ‘বরফি’ সিনেমাতেও ব্যবহৃত হয়েছে এই ঐতিহ্যবাহী মুখোশ। বিস্তারিত জানতে নিচে আরোও পড়ুন…..

উল্লেখ্য, চড়িদা গ্রামেই জন্মেছিলেন প্রবাদপ্রতিম ছৌ শিল্পী ‘পদ্মশ্রী’ গম্ভীর সিং মুড়া। তাঁর হাত ধরে বাংলার ছৌ-নাচ ও এই শিল্প বিশ্বের দরবারে পৌঁছে গিয়েছে। জানা যায়, প্রায় দেড়শ বছর আগে বাঘমুন্ডি রাজাদের হাত ধরে ছৌ-নাচে এই চড়িদার মুখোশের ব্যবহার শুরু হয়েছিল। বাঘমুন্ডির রাজপরিবারের দুর্গাপুজোয় প্রতিমা গড়তে এসেছিলেন বর্ধমানের সূত্রধরেরা। তাদের মাধ্যমেই মুখোশের প্রচলন শুরু হয়েছিল। তারপর আস্তে আস্তে এই শিল্পের চাহিদা বাড়তে থাকে। গ্রামের বেশিরভাগ পরিবারের পদবীই সূত্রধর। অন্যান্য পদবীর পরিবারও রয়েছে। গ্রামের প্রত্যেকটা বাড়ি, ছোটো ছোটো দোকানঘরের দাওয়া যেন এক-একটি ‘আর্টচালা’। দেশীয় পর্যটকদের পাশাপাশি বহু বিদেশী পর্যটক ও গবেষক বছরের বিভিন্ন সময়ে এই গ্রামে আসেন। চড়িদা গ্রামের এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পকর্মকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার লক্ষ্যে একাধিক উদ্যোগ নিয়েছে ইউনেস্কো ও প্রশাসন। বিস্তারিত জানতে নিচে আরোও পড়ুন…..

ইতিমধ্যেই জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডেক্স(জি-আই) ট্যাগ পেয়েছে চড়িদা গ্রামের ছৌ-মুখোশ। শিল্পীদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে সংগঠন। সরকারি উদ্যোগে গ্রামেই অনুষ্ঠিত হয় মুখোশের শিল্পমেলা। চড়িদার মুখোশ শিল্পীরা বাংলা ও দেশের বিভিন্ন স্বনামধন্য শিল্পমেলায় নিজেদের শিল্পকর্মের পসরা সাজিয়ে বর্তমানে হাজির হচ্ছেন। গ্রামে নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয় নানা কর্মশালা। গ্রামেই গড়ে উঠেছে রিসোর্স সেন্টার। আর সেখানেই রয়েছে ছৌ-মুখোশের উপর বিশেষ কমিউনিটি মিউজিয়াম। যাঁরা লোকশিল্পকে ভালোবাসেন, সংস্কৃতিকে ভালোবাসেন, খুব সামনে থেকে ছৌ-মুখোশ শিল্পকে দেখতে চান, জানতে চান তাঁদের কাছে ফেভারিট ডেস্টিনেশন যে পুরুলিয়ার চড়িদা গ্রাম তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। পুরুলিয়া থেকে ঘন্টা দেড়েকের পথ। নিকটবর্তী স্টেশন বরাভূম। খুব সহজেই চলে আসা যায় চড়িদার বুকে। চড়িদার সাথ উপরি পাওনা অযোধ্যা পর্যটন সার্কিটের নানা মনোমুগ্ধকর স্থান। তাই আর দেরি কেন সপ্তাহান্তে বেরিয়ে পড়ুন চড়িদার উদ্দেশ্যে।