কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের পেঁড়োর বাড়িতে বছরভর চলে ‘দুর্গা’র আরাধনা

By নিজস্ব সংবাদদাতা

Published on:

নিজস্ব প্রতিবেদক : সময়টা অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় বাংলায় সূচনা করলেন দেবী অন্নপূর্ণার আরাধনা। তিনি হাওড়া জেলার এক বিদগ্ধ সাহিত্য ব্যক্তিত্বকে অনুরোধ করলেন মা অন্নপূর্ণার মাহাত্ম্য সম্পর্কে কাব্য রচনার করার। ১৭৫২ সালে সেই প্রবাদপ্রতিম সাহিত্য ব্যক্তিত্ব লিখলেন ‘অন্নদামঙ্গল’। রাজা তাঁকে ‘রায়গুণাকর’ উপাধিতে ভূষিত করলেন। আজও তিনি বাংলা সাহিত্য জগতের অন্যতম উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক রূপে বিরাজমান।

হাওড়া জেলার পেঁড়ো গ্রামে জন্মেছিলেন ‘অন্নদামঙ্গল’-এর স্রষ্টা রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র। বঙ্গসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই কবির পরিবারের দুর্গোৎসব কয়েকশো বছরের প্রাচীন। পুজোর বয়স ঠিক কত তা জানা নেই রায় বাড়ির বর্তমান সদস্যদের। তবে কবি নিজের বাল্যকালে তাঁর পারিবারিক এই দুর্গোৎসবে পুষ্পাঞ্জলি দিতেন বলে জানা যায়।

রায় পারিবারিক আরাধ্য দেবতা নারায়ণ। জন্মাষ্টমী তিথিতে নারায়ণের বিশেষ আরাধনার মধ্য দিয়েই ঢাঁকে কাঠি পড়ে। পেঁড়োয় রয়েছে ‘রণ’ নদী। শোনা যায়, এই নদীর তীরেই রাণী ভবাশঙ্করীর সাথে পাঠানদের যুদ্ধ হয়েছিল। সেই নদী থেকে আনা ১০৮ কলসী জলে নারায়ণকে স্নান করানো হয়। স্নানের জলে সিক্ত নরম মাটি থেকেই গড়ে ওঠে কবির বাড়ির মৃন্ময়ী মা। জমিদার বাড়িতেই রয়েছে ঠাকুর দালান। চিরাচরিত প্রথানুযায়ী এই দালানেই মা পূজিতা হন। তবে রায় বাড়িতে মা দুর্গা শুধু পুজোর ক’টা দিনই নন, সারাবছরই বাড়ির ঠাকুর ঘরে ‘জয় দুর্গা’ হিসাবে অষ্টধাতু পূজিত হন।

রায় পরিবার সূত্রে জানা গেছে, একচালা মূর্তিতে এখানে প্রতিমা গড়া হয়। তবে এখানকার অন্যতম বৈশিষ্ট্য একচালায় মা দুর্গার পাশে উপরে থাকেন কার্ত্তিক, গণেশ। নীচে থাকেন লক্ষ্মী ও সরস্বতী। যা প্রায় বিরল। পরিবারের অন্যতম সদস্য পঙ্কজ কুমার রায় বলেন, “একচালা প্রতিমায় সাধারণত মা দুর্গার পাশে উপরে থাকেন লক্ষ্মী ও সরস্বতী। যদিও আমাদের বাড়িতে বিপরীত নিয়মে একচালা প্রতিমা গড়া হয়। আমরা বর্ধমান রাজার অধীনে জমিদার ছিলাম। বর্ধমান রাজ বাড়িতেও ঠিক আমাদের নিয়মেই একচালা প্রতিমা গড়া হয়। তাঁদের নিয়ম অনুসরণ করেই হয়ত আমাদের পূর্বপুরুষরা এই প্রথা প্রচলন করেছিলেন।”

অবসরপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী পঙ্কজ বাবু জানান, “আমাদের রায় পরিবারের বিশেষ এস্টেট দ্বারাই এই পুজো পরিচালিত হয়। এস্টেটের পুকুর, জমি সহ বিভিন্ন সম্পত্তি রয়েছে। তার আয় থেকেই পুজোর খরচের জোগান দেওয়া হয়। কোনোরকম কারুর থেকে অর্থসাহায্য নেওয়া হয়না।”

জানা গেছে, সপ্তমী ও অষ্টমীতে দু’টি করে ছাগবলি ও নবমীতে তিনটি ছাগবলি দেওয়া হয়। থাকে অন্নকূটের ব্যবস্থা। জমিদার বাড়ির এই ঐতিহ্যবাহী পুজো দেখতে আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামের অসংখ্য মানুষ আসেন। প্রথা মেনে আজও কৃষ্ণানবমীতে পুজো শুরু হয়। চলে পরবর্তী নবমী তিথি অব্ধি। অর্থাৎ, ১৫ দিন।

কিন্তু, এবার মলমাস পড়ে যাওয়ায় পুজোর সময়কালটাও কমেছে বলে বাড়ির সদস্যরা জানান। কালের নিয়মে পুজোর জৌলুস বেশ কিছুটা কমলেও সাবেকিয়ানা আর ঐতিহ্য অটুট ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের স্মৃতি বিজড়িত এই বনেদী বাড়ির দুর্গোৎসব।