পৃথ্বীশরাজ কুন্তী: কখনো পরিবেশিত হত রাজবাড়ির জলসাঘরে, কখনো বা জমিদার বাড়ির অন্দরমহলে।কালের নিয়মে লুপ্ত হয়েছে জমিদারি প্রথা কিমবা রাজার রাজত্ব।প্রাসাদের জলসাঘর থেকে শিল্পের স্থান হয়েছে মাঠে-ময়দানে-মুক্তমঞ্চে।বাংলার বুক থেকে হারিয়ে যেতে বসা এমনই এক লোকশিল্পের নাম লেটো ভাঁড় যাত্রা।একসময় রাঢ়বঙ্গে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করা এই লোকশিল্প আজ প্রায় অবলুপ্তির পথে।লেটোগান মূলত যাত্রারই একপ্রকারভেদ।যাত্রাগানের মতোই পালার আকারে রচিত এই গান নৃত্য ও অভিনয়সহ পালা পরিবেশন করা হয়;সঙ্গে থাকে বাদকদল।বাঙালির কাছে গোপাল ভাঁড় এক অত্যন্ত পরিচিত ও জনপ্রিয় নাম।জানা যায়,রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বিদূষক গোপাল ভাঁড় তাঁর প্রখর বুদ্ধির জন্য বিখ্যাত ছিলেন।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদীয়ার মানুষের মুখে মুখে ছিলো গোপাল ভাঁড়ের নাম, প্রতিদিনই কিছু না কিছু কান্ড ঘটিয়ে লোককে জব্দ করতেন। সে গল্প বিভিন্ন লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়তো আশেপাশের সমগ্র অঞ্চলেও।যদিও প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ও ভাষাবিদ সুকুমার সেন বলেছেন “গোপাল ভাঁড় সম্পর্কে আধুনিক বাঙালির কৌতুহল থাকার ফলে বাস্তব অথবা কল্পিত ব্যক্তিটির সম্পর্কে যে জনশ্রুতি জাতীয় ঐতিহ্য গজিয়ে উঠেছে ও উঠছে, তার বীজ হচ্ছে ভাঁড় নামের অংশটি,গোপাল ভাঁড়ের ভাঁড়টুকু সংস্কৃত শব্দ ভাণ্ডারের ‘ভাণ্ড’-জাত মনে করে অনেক গোপালের জাতি নির্ণয় করেছেন।” সুকুমার সেনের মতে, গোপাল বলে হয়তো কেউ ছিলেন না, লোকমুখে সৃষ্ট হয়েছেন এই ‘গোপাল ভাঁড়’। মূলত,গোপাল ভাঁড়ের গল্পগুলোকেই হাস্যরসের সাথে সংমিশ্রণ করে ভাঁড় যাত্রা রূপে উপস্থাপন করা হয় গ্রাম বাংলার বুকে।
দেশমাতৃকা কিমবা বিভিন্ন দেবদেবীর বন্দনা দিয়ে পালার শুরু হয়।সখী,সঙদার,পাঠক বিভিন্ন নামে নট-নটীরা গান ও নাচ পরিবেশন করেন।এর বিষয়বস্তু প্রধানত সামাজিক রঙ্গরস ও আটপৌরে গ্রামীণ জীবন। হাওড়া জেলায় আগে বেশ কয়েকটি দল থাকলেও এখন জেলায় মাত্র একটি লেটো ভাঁড় যাত্রার সম্প্রদায় রয়েছে উদয়নারায়ণপুর ব্লকের ইটারাই গ্রামে।ভাঁড় যাত্রা মঞ্চস্থ করতে আমতা-১ ব্লকের উদং গ্রামের কৃষিমেলায় হাজির হয়েছিলেন এই সম্প্রদায়ের কুশীলবরা।সম্প্রদায়ের কর্ণধার রূপকুমার প্রামাণিক হতাশার সুরে বলেন,একসময় রাঢ় বাংলার বিভিন্ন জমিদার বাড়িতে এই শিল্পের কদর থাকলেও আজ তা বিপন্নপ্রায়।তবে আশার আলো বর্তমান রাজ্য সরকারের প্রচেষ্টায় অন্যান্য লোকশিল্পের মতো এই শিল্পও প্রাণ ফিরে পেয়েছে।
যদিও বর্তমান যুব সমাজের সিংহভাগই লেটো যাত্রা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।বছরঘুরে হয়ত হাতেগোনা ২৫-৩০ টা শো’য়ের ডাক মেলে।প্রতি শো পিছু তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর প্রত্যেক শিল্পীকে ১০০০ টাকা সাম্মানিক হিসাবে দেয়।” রূপকুমার বাবু আরও বলেন,যাত্রার পালাগুলি ৩ ঘন্টার হলেও বর্তমানে দর্শকদের কথা মাথায় রেখে দেড় থেকে দু’ঘন্টায় পালাগুলি মঞ্চস্থ করা হয়।দর্শকদের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে আধুনিক বিভিন্ন গান যুক্ত করা হয়েছে পালার বিভিন্ন অংশে।রূপকুমার বাবুর ‘আদ্যামা লেটোযাত্রা’ সম্প্রদায়ে বর্তমানে ১২ জন শিল্পী রয়েছেন।যাঁর মধ্যে রয়েছেন ৪ জন মহিলা।শিল্পীদের কেউ কৃষিক্ষেত্রে যুক্ত,কেউ ব্যবসার কাজে আবার বা কেউ গৃহবধূ।শুধুমাত্র এই ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্পের টানে বাংলার বুক থেকে হারিয়ে যেতে বসা এই সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদেই তাঁরা জেলার বিভিন্ন প্রান্তে মঞ্চস্থ করেন গোপাল ভাঁড়ের গল্পগুলো।শুধু যে মানুষকে হাসান তা নন,পাশাপাশি হাস্যকৌতুকের মধ্য দিয়েই সমাজের কাছে রেখে যান মানবিকতার শুভবার্তা।
নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করেন অনিমা পন্ডিত।অনিমা দেবী বিষন্ন গলায় বলছিলেন,জমিদার বাবুদের বাড়িতে এই ভাঁড় যাত্রার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কোনো সামাজিক মর্যাদা ছিলনা।তৎকালীন সমাজও তাঁদের ভিন্ন চোখে দেখত।তাঁর আক্ষেপ সময়ের রথচক্র ঘুরে গেলেও আজও সমাজের চোখে বহুলাংশেই ব্রাত্য থেকে যান তাঁদের মতো ভাঁড় যাত্রার কলাকুশলীরা।মুখ্যমন্ত্রী এই শিল্পকে বিকশিত করার লক্ষ্যে একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও কিছু অসাধু মানুষের জেরে বঞ্চিতই থেকে যান তাঁরা।‘গোপাল ভাঁড়’ শুধু একটি নাম নয়,একটি সময়ের প্রতিচ্ছবিও বটে। একটি নির্দিষ্ট সময়ে মানুষের জীবনযাপনকেও প্রতিফলিত করে তাঁর গল্পগুলো। বাংলা সাহিত্য কিমবা লোককাহিনী,গোপাল ভাঁড় একটি চিরায়ত ও অবিচ্ছেদ্য অনন্য চরিত্র।আর সেই গোপাল ভাঁড়ের হাস্যরসাত্মক বার্তাগুলোই আজও সমাজের কাছে দিয়ে যান রূপকুমার বাবুর মতো গ্রামীণ লোকশিল্পীরা।