গুরু-শিষ্যের সৌজন্য রক্ষা! আমতার তাজপুরে এক বাড়ির ‘দুর্গা’ যান অপরের বাড়িতে

By নিজস্ব সংবাদদাতা

Published on:

নিজস্ব প্রতিবেদন : গ্রামীণ হাওড়ার আমতা-২ ব্লকের তাজপুর গ্রামের রায় পরিবার। বর্ধমান রাজার থেকে জমিদারি পাওয়ার পর রাজাদের উৎসাহেই প্রজাদের আনন্দদানের উদ্দেশ্যে ৯২০ বঙ্গাব্দে দুর্লভ রায়ের হাত ধরে চালু হয় এই বনেদি পরিবারের দুর্গোৎসব। একসময় এই পুজো এতো জাঁকজমকপূর্ণ ছিল যে কাশী থেকে পাঁচজন পুরোহিত আনা হতো, চালু ছিল মোষবলি প্রথা, বসত যাত্রার আসর। ভিড় জমাতেন আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামের মানুষ।

অন্যদিকে, দামোদরের তীরবর্তী এই গ্রামেই ভট্টাচার্য পরিবারের বাস। রায় বাড়ির দুর্গোৎসবের প্রবর্তক তথা দুর্লভ বাবুর সময়কালে উত্তর ভারত থেকে পান্ডিত্যের সম্ভার নিয়ে তাজপুরে আসেন হরিহর ভট্ট। তাঁর হাত ধরেই মূলত গ্রামে সংস্কৃত শিক্ষার আলো প্রজ্জ্বলিত হয়। তৎকালীন রায় বংশে ‘তর্কলঙ্কার’, ‘তর্কবাগীশ’ -এর সংখ্যাটা নেহাত কম ছিলনা। তাঁর উদ্যোগেই আবাসিক চতুষ্পাঠী গড়ে ওঠে তাজপুর গ্রামে।

উল্লেখ্য, এই গ্রামেই মামার বাড়ি ছিল প্রবাদপ্রতিম কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের। সেই সূত্র ধরেই তিনিও আসতেন টোলে বলে জানা যায়। এছাড়াও বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিক্ষানবিশরা সংস্কৃত শিক্ষায় দক্ষতা অর্জনের আসতেন বর্তমানে আমতা থানার অন্তর্ভুক্ত এই গ্রামে। ভট্টাচার্য পরিবারের সাথেও বর্ধমান রাজার সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে।

প্রসঙ্গত, বর্ধমানের রাজার প্রেরণাতেই এই চতুষ্পাঠী গড়ে তোলেন হরিহরবাবু। রাজার উৎসাহেই ভট্টাচার্য বাড়িতেও শুরু হয় দুর্গোৎসব।রাজা এই পুজো চালানোর জন্য জমিদান করেন। এই জমির আয়ই মূলত দুর্গোৎসবের খরচের জোগান দিত।

কেটে গেছে বেশ কয়েক শতক, কালের অমোঘ নিয়মে হারিয়ে গেছেন দুর্লভ বাবু, হরিহর বাবুর ন্যায় ব্যক্তিত্ব। ছেদ পড়েছে জৌলুসে, ফিকে হয়েছে বনেদীয়ানায়। আর্থিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও শত বছরের গ্রামীণ ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে বহন করে চলেছে তাজপুর গ্রামের এই দুই দুর্গোৎসব। কালের নিয়মে বিভিন্ন প্রথা বিস্মৃতির অতল গভীরে হারিয়ে গেলেও আজও স্বমহিমায় প্রচলিত আছে এক বিশেষ প্রথা।

রায় বাড়ির গুরু বংশ ছিল ভট্টাচার্য পরিবার। তাই উভয় পরিবারের সৌজন্য রক্ষার্থে এই বিশেষ প্রথার উদ্ভব। সেই প্রথানুযায়ী আজও বিজয়া দশমীতে রায় বাড়ির সদস্যেরা তাঁদের বাড়ির মা’কে নিয়ে আসেন ভট্টাচার্য বাড়িতে। ভট্টাচার্য পরিবারের মহিলারা রায় বাড়ির মা’কে বরণ করেন। চলে মিষ্টিমুখ পর্ব।

তারপর ফিরিয়ে আনা হয় রায় বাড়িতে। সাথে আনা হয় ভট্টাচার্য বাড়ির মা’কে। রায় পরিবারের ঠাকুর দালানে তখন কয়েকশো মানুষের ভিড়। দুই বাড়ির মৃন্ময়ী মা’কে বসানো হয় মন্ডপে। বরণ করা হয় দুই বাড়ির প্রতিমাকে। তারপর বিসর্জনের উদ্দেশ্যে রওনা। এভাবেই শতবছরের ইতিহাস – সংস্কৃতি – ঐতিহ্যের ধারাকে বহন করে চলেছে দামোদর তীরবর্তী গ্রামের এই দুই পুজো।