পৃথ্বীশরাজ কুন্তী : বিশ্ব তথা ভারতের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্ন্যাসী, যুগপুরুষ তথা বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের মূর্ত প্রতীক বিশ্ববরেণ্য মহামানব স্বামী বিবেকানন্দের জীবন – বাণী-দর্শন আমাদের চলার পথের পাথেয়। সেবাব্রত ও শুভব্রতের পূত – পবিত্র উজ্জ্বল আলোকে ভাস্মর ত্যাগ প্রদীপ্ত কর্মমুখর এই জীবন আমাদেরকে প্রত্যেক মূহুর্তে প্রাণিত করে। এই মহান মানুষটিও দুঃখ – কষ্টের অনলে বেশকিছুবার দগ্ধ হয়েছিলেন। অন্তরের অন্তঃস্থলে গভীর ব্যথা অনুভব করলেও কখনই তিনি দুঃখ – কষ্ট নামক বিভীষিকাময় শক্তির কাছে মাথা নত করেননি। বোনেদের অকাল মৃত্যু কিমবা বাবার মৃত্যুতে পরিবারের চরম আর্থিক সংকট অথবা চরম পারিবারিক জমি বিবাদ বা সেই সংক্রান্ত মামলা – মকদ্দমা — প্রত্যেক প্রতিকূল অবস্থার বিরুদ্ধে তিনি মাথা উঁচু করে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। তাইতো তিনি পরম বন্ধু খেতড়িরাজ অজিত সিংহকে বলেছিলেন, “সতত প্রতিকূল অবস্থামালার বিরুদ্ধে আত্মপ্রকাশ ও আত্মবিকাশের চেষ্টার নামই জীবন।”
এই মহামানবের জীবনের পথটা কখনোই কুসুমাস্তীর্ণ ছিলনা; জীবনযাত্রাপথে কন্টকাকীর্ণ পথ ধরে নগ্নপদে বিচরণ করতে গিয়ে তিনি কীভাবে কন্টকে বিদ্ধ হয়েছিলেন এবং সেই প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও রক্তমাখা চরণতলে পথের কন্টককে তিনি কেমন নির্ভীকভাবে দলনের আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন সেই সম্পর্কে দুঃখ – কষ্ট – বিরহে জর্জরিত বর্তমান সমাজ তথা ভাগ্যহত মানুষ জীবন সংগ্রামে জয়ী হবার ভরসা খুঁজে পাবেন। প্রথমেই আসা যাক বোনেদের মৃত্যু সংক্রান্ত ব্যাপারে। স্বামীজি একদা নিজেই ঠাট্টার সুরে বলেছিলেন, “আমাদের আত্মহত্যার বংশ।” খুব একটা খারাপ কিছু বলেননি।স্বামীজির দুই দিদি ও দুই বোন। নরেন্দ্র – সান্নিধ্যের মধুরস্মৃতি বিজড়িত তাদের শৈশব। তাদের তিনজনের জীবন গভীর রহস্যে আচ্ছাদিত, বেদনার মূক। বিশ্বাচার্যের ঘরের কাহিনীই বড়োই মর্মন্তুদ। যুগসূর্যের আলয়েই যুগযন্ত্রণার জমাট বাধা এক নিবিড় অন্ধকার।
স্বামীজির জ্যেষ্ঠা ভগিনী ছিলেন হারামণি দেবী। জন্ম ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে। হারামণি দেবীর বিয়ে হয় হাওড়ার আমতার খড়িয়প গ্রামের বসু জমিদারবাড়ির সুপুত্র মাখনগোপাল বসুর সহিত। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার যে হারামণি কন্যাসন্তানের (নাম-শিবকালী) জন্ম দিলে পরিবারের সকলের কাছে অপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তার স্বামী অন্য এক রমণির (তিনিও আবার স্বামিজীর কাকার মেয়ে) সাথে সম্পর্কে লিপ্ত হন। আর তা থেকেই দুঃখে – ক্ষোভে ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন হারামণি। আবার অন্য একটি সূত্র মারফত জানতে পারা যায় যে, হারামণি দেবীকে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছিল। ২২ বছরে প্রিয় দিদির চলে যাওয়া যুবক নরেনের মনে গভীর দুঃখ ও যন্ত্রণার সৃষ্টি করে। কিন্তু শোকসন্তপ্ত নরেন কখনোই ভেঙে পরেননি। বরং দিদির মৃত্যুর কয়েকদিন পর আমতায় আসেন ও নাবালিকা ভাগ্নি শিবকালীকে নিয়ে কোলকাতায় ফিরে যান। পরবর্তীকালে শিবকালী মামা – দিদিমার সাহচর্যেই বড়ো হয়ে উঠেছিলেন।
এরপর আসা যাক, বিবেকানন্দের তৃতীয় ভগিনী কিরণবালার কথায়। কিরণবালার জন্ম ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে। মাত্র ন’বছর বয়সেই বিয়ে হয় সোনারপুর নিবাসী গোপালচন্দ্র বসুর সাথে। দীর্ঘকাল কিরণবালার সন্তানাদি না হওয়ায় আত্মীয় ও পরিজনদের গঞ্জনা শুনতে হত। ‘অন্নপূর্ণা’ নামক এক অনাথ কন্যাকে দত্তক নেন। অন্নপূর্ণা বয়স যখন বছর তিনেক কিরণবালা তখন গর্ভবতী হন। ১৮৮৩ সালে এক পুত্রসন্তান প্রসবের পর তার আর জ্ঞান ফেরেনি। ষোলো বছর বয়সে কিরণবালার মৃত্যু হয় (স্বামীজির কনিষ্ঠ ভ্রাতা ভূপেন্দ্রনাথের লেখা থেকে)। আবার কিরণবালার পরিবারমতে তার মৃত্যু ১৮ বছর বয়সে। এরপর আলোকপাত করা যাক, স্বামীজির কনিষ্ঠ ভগিনী ও বহুল আলোচিত যোগেন্দ্রবালার কথায়। জন্ম ১৮৬৭ খ্রিস্টব্দে। যোগেন্দ্রবালার সহিত উচ্চশিক্ষিত ও ব্রিটিশ সরকারে চাকুরীরত রামচন্দ্র মিত্রের সাথে বিবাহ হয়। রামচন্দ্র বাবু ব্রিটিশ সরকারের উচ্চপদস্থ অফিসার হওয়ায় ব্রিটিশ রাজপ্রতিনিধিদের অনুষ্ঠানে প্রায়শই সস্ত্রীক যেতে হত। যোগেন্দ্রবালা ছিলেন অত্যন্ত দৃঢ়চেতা রমণী। প্রথম কয়েকবার স্বামীর সাথে গেলেও কোনোভাবেই পরে আর যেতে রাজি ছিলেন না। তা থেকেই শুরু হয় প্রবল দাম্পত্য কলহ। তার উপর স্বামীর মদ্যপান করাকে তিনি মেনে নিতে পারেননি। তাই ১৮৯০ সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে সিমলার সরকারি আবাসনের রান্নাঘরে গলায় কাপড়ের ফাস দিয়ে আত্মহত্যা করেন স্বামিজীর এই ভগিনী। কনিষ্ঠ ভগিনীর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে স্বামীজির স্নেহপ্রবণ মন দুঃখে অবসন্ন হয়ে পড়ে।
আবার অন্যদিক থেকে যদি বলা যায় (যদিও আমার ব্যক্তিগত অনুমান) এই অতি বিষাদময় বিবরণের মাধ্যমে ভারতীয় নারীজীবনের বেদনাঘন দিকের এক প্রত্যক্ষ প্রমাণ তিনি পেলেন এবং তা প্রতিকারের জন্য এই মহামানবের প্রাণ কেঁদে উঠল। ১৯০০ সালের ১৫ ই ফেব্রুয়ারি লস-এঞ্জেলস থেকে মিসেস সারা বুলকে লেখা চিঠিতে বিবেকানন্দ লিখেছিলেন, “আমার বোনের একখানি পত্রে জানলাম যে, তার পালিতা কন্যা মারা গেছে। ভারতের ভাগ্যে যেন একমাত্র দুঃখই আছে। তাই হোক! সুখদুঃখে আমি যেন বোধশূন্য হয়ে গেছি।” —স্বামীজির এই চিঠি থেকেই অনুধাবন করা যায় যে তিনি ভগিনীদের মৃত্যুতে কতটা আঘাত পেয়েছিলেন। অন্যদিকে, সোনার সংসারের সোনার ছেলে নরেন্দ্রনাথ পিতা বিশ্বনাথ দত্তের আকস্মিক মৃত্যুতে এক প্রবল ঘূর্ণাবর্তের সম্মুখীন হয়েছিলেন। একমাত্র উপার্জনকারীর চলে যাওয়াতে পরিবারে নেমে আসে চরম আর্থিক বিপর্যয়। এমনই চরম সংকটের সম্মুখীন হয় এই পরিবার যে, ২১ বছরের যুবক নরেন সকালে উঠে গোপনে বাড়িতে অনুসন্ধান চালাতেন যে বাড়িতে সকলের পর্যাপ্ত খাবার আছে কিনা। যদি দেখতেন পর্যাপ্ত খাবার নেই; মাকে বলতেন ‘আমার নিমন্ত্রণ আছে’। এই বলে বাইরে সামান্য কিছু খাবার জুটলে খেতেন, কোনোদিন আবার হয়তো অনশনেই কাটিয়ে দিতেন ভাবী এই যুগনায়ক।
সদ্য যুবক নরেন ও তার পরিবার যখন চরম আর্থিম অনটনের সম্মুখীন ঠিক সেই সংকটময় পরিস্থিতিতে বেশ কিছু বন্ধু তাকে টাকা উপায়ের জন্য বিভিন্ন অসৎ উপায়ের সম্মুখীন হওয়ার পরামর্শ দেয়। কিন্তু দৃঢ়চেতা এই ব্যক্তিত্ব সুচাতুরভাবে সমস্ত কিছুকে অবজ্ঞা করে সৎ পথে আগামীর পথে অগ্রসর হন। এমনকি নরেন এক রমণীর শরীরের প্রলোভনেও কোনোভাবে পা দেননি। তার পরিবর্তে সেই রমণীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “আপনার মঙ্গল হোক আমি চাই। আপনি যদি বুঝে থাকেন যে, এভাবে জীবনযাপন করা পাপ, তবে একদিন না একদিন আপনি এ থেকে উদ্ধার পাবেন নিশ্চই।” আবার এমনও দিন গেছে যে মা নরেনকে আহ্নিকের জন্য একখানা কাপড় কিনে দিতে বললে অসহায় নরেন মাথা নত করে চলে যায়। এইসময় ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ভক্তের দেওয়া একটা কাপড় নরেনকে তার মায়ের জন্য দিতে চাইলে সুদৃঢ়চেতা ‘বিলে’ তা নিতে অস্বীকার করেন। এত দুঃখকষ্ট – বেদনা – আঘাতের মধ্যেও তিনি কখনই নিজের আদর্শ, বিবেক, বুদ্ধি, সততাকে বিসর্জন দেননি। তাইতো তিনি হতে পেরেছেন বিশ্বপ্রণম্য, বিশ্ববরেণ্য, সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। এত দুঃখকষ্টের মাঝেও আস্তিকবুদ্ধির বিলোপ ঘটেনি। তিনি সবসময় বিশ্বাস করতেন ঈশ্বর মঙ্গলময়। যদিও তিনি ঈশ্বরকে খুঁজে পেয়েছিলেন রক্তমাংসের শরীরের মাঝে। তাইতো তিনি বলতে পেরেছিলেন, “জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর” অথবা “জীবসেবাই শিবসেবা।”
পক্ষান্তরে, বিবেকানন্দের পারিবারিক সম্পত্তির বিবাদ তাঁর জীবনকে বেদনাময় করে তুলেছিল। বিশ্বনাথ দত্তের আকস্মিক প্রয়াণের পরই ভুবনেশ্বরী দেবী ও তার জ্যেষ্ঠ পুত্র নরেন্দ্রনাথ দত্তের অন্তহীন জীবনসংগ্রামের সূচনা ঘটে। যৌথ পরিবারকেন্দ্রিক জীবনযাত্রায় বিরক্ত হয়ে ভুবনেশ্বরী দেবী সন্তানদের নিয়ে স্বামীর ভিটে পরিত্যাগ করে ভাড়া বাড়িতে উঠে আসেন। বিশ্বনাথবাবুর মৃত্যুর পর পরিবারের কোনো সদস্যই ভুবনেশ্বরী দেবীকে কানাকড়ি দিয়ে পাশে তো দাঁড়াননি, তার পরিবর্তে আরও মামলা – মকদ্দমায় জর্জরিত করে তাঁদের পরিবারের অন্যান্য সদস্যগণ। বলা বাহুল্য, এই অনাবশ্যক শরিকী লড়াই বিবেকান্দের স্বল্পপরিসর জীবনকে বিষাদময় করে তুলেছিল। এই দুর্বিষহ যন্ত্রণা না থাকলে হয়তো তিনি আরও বেশ কিছুদিন বাঁচতেন। একদিকে প্রবল পারিবারিক আর্থিক সংকট পক্ষান্তরে মামলার খরচ জোগাতে প্রায় পথে বসেন নরেন্দ্রনাথ ও তাঁর মা। এইসব ঘটনা বা তথ্য প্রমাণ করে যে এই মহামানবের জীবনও ছিল দুঃখ – শোকে ভরপুর। কিন্তু নির্ভীক সৈনিকরূপে সেই দুঃখ নামক বাধাকে জয় করতে পেরেছিলেন বলেই ভবিষ্যতে ‘বিবেকানন্দ’ নামক পুরুষোত্তম হয়ে উঠেছিলেন। সে কথা স্বামীজি নিজেই পরে বলেছিলেন। নরেন্দ্রনাথ একদিন মাস্টারমশাই মহেন্দ্রনাথ গুপ্তকে বলেছিলেন, “অনেক দুঃখকষ্ট পেয়ে তবে এই অবস্থা হয়েছে আমার। মাস্টারমশাই আপনি দুঃখকষ্ট পান নাই; জানি দুঃখকষ্ট না পেলে ঈশ্বরের হস্তে সমপর্ণ হয়না।”
সেই দুঃখকষ্টকে জয় করতে পেরেছিলেন বলেই তিনি জন্ম সার্ধশতবর্ষ পার করেও সর্বজনবরেণ্য, চিরনমস্য, প্রাতঃস্মরণীয় ও ঘরে ঘরে নিত্যপূজিত। এই মহামানবের সৃষ্টি – ভাবনা – ত্যাগ – তিতিক্ষা – কর্ম – সংস্কৃতি – অমূল্য বাণীর পাশাপাশি জীবনসংগ্রামের প্রত্যেক মূহুর্ত বিশ্বের অগণিত ছাত্র – যুব – নারী তথা মানবজাতিকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে। তাই স্বামীজির জীবন সংগ্রামের সেই মহান মন্ত্রের মধ্যদিয়েই আমার এই ক্ষুদ্র লেখা শেষ করলাম— “সর্বদা বলো, আমি নির্ভীক, আমার কোনো ভয় নেই।”