ক্রেতার অধিকার – মালা ব্যানার্জী

By নিজস্ব সংবাদদাতা

Published on:

ক্রেতার যে অধিকারগুলি আছে তা যদি সঠিক ভাবে পর্যালোচনা করা যায় তাহলে দেখা যাবে প্রায় বেশীরভাগ দৈনন্দিন কেনাকাটার সমস্যার সমাধান হচ্ছে। ক্রেতাকে কেনাকাটার কিছু সু-অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। ক্রেতার অধিকারের সঙ্গে কর্তব্যের কথাও এসে পড়ে। পরে কর্তব্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো। তবে একটা কথা বলা দরকার যে, কোনো অধিকারই নিজে নিজে আসে না তা আদায় করে নিতে হয়। অবশ্যই কী অধিকার আদায় করতে হবে তার একটি সম্যক জ্ঞান থাকা দরকার। ছ’টি অধিকার ক্রেতা সুরক্ষা আইনে সবিস্তারে বর্ণনা করা আছে। এত চমৎকার ভাবে এই ছ’টি অধিকার ব্যক্ত করা হয়েছে যে সারাদিনের কেনাকাটা কিংবা গৃহস্থালির জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছুই এই সব অধিকারের আওতায় আছে। নীচে ছ’টি অধিকারের বিস্তারিত আলোচনা করলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। ১। নিরাপত্তার অধিকার,
২। বেছে নেওয়ার অধিকার,
৩। খবরা খবরের অধিকার,
৪। শিক্ষার অধিকার,
৫। প্রতিনিধিত্বের অধিকার,
৬। প্রতিকারের অধিকার; বাজারে বিক্রিত দ্রব্যের নিরাপত্তার দিকটি বিশেষ জরুরী হিসাবে গণ্য হয়। নিরাপত্তার প্রতীক হিসাবে আইএসআই চিহ্ন দেখে নিতে হবে। সরকারী পরীক্ষাগারে পরীক্ষিত দ্রব্যতে আইএসআই এই প্রতীকটি দেওয়া থাকলে তবে ধরে নিতে হবে যে দ্রব্যটি নিরাপদে ব্যবহার করা যাবে। ভারতীয় মানক সংস্থা ভারত সরকারের অধীনে অবিরাম পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাচ্ছেন। যাবতীয় বিদ্যুৎ চালিত যন্ত্রপাতি, স্টোভ, ওভেন, বাড়ী তৈরীর মশলাপাতি এবং যন্ত্র, কলকব্জা, বিস্কুট, ডালডা বনস্পতি থেকে আরম্ভ করে প্রেসার কুকার, ব্যাটারী পর্যন্ত এক বিরাট অংশের দ্রব্যই আইএসআই এর আওতায় আছে। যখন আমরা বাজার করে আনি তখন যদি দ্রব্যটি ভালোভাবে দেখে কিনি অর্থাৎ আইএসআই প্রতীক চিহ্নটি আছে কিনা তবে বস্তুটি মোটামুটি ভাবে নিরাপদ গণ্য করা যাবে। সেইরকমই জ্যাম, জেলী, আচার যাবতীয় দ্রব্য যা কিনা রাসায়নিক পদ্ধতিতে অ্যাসিড প্রভৃতি দিয়ে বোতলে রেখে বেশ কিছু দিন পর্যন্ত ব্যবহার করা যায় কিংবা খাওয়া যায় তাতে এফপিও চিহ্ন দেখে নিতে হবে। বনস্পতি কিংবা কৃষিজাত দ্রব্যতে আগমার্ক চিহ্ন দেখে নিতে হবে। পোষাকের কাপড়ে ট্রেড মার্ক দেখে নিতে হবে। এই উপরোক্ত চিহ্নগুলিকে নিরাপদ ভাবা হয়। বাজার করার সময় হাতে সময় নিয়ে দেখেশুনে বেছে জিনিস কেনা অভ্যাস করতে হবে। কাঁচাবাজার করবার সময় আলু পটলের ঝুড়িতে হাত ঢুকিয়ে দেখে বেছে জিনিস কিনতে হবে। মাছ কেনার সময় কানকো-টি খুলে রং দেখতে হবে। এইরকম নানাবিধ দ্রব্য ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে জিনিস কিনুন। বেছে নেওয়ার অধিকার একটি আইনগত অধিকার। প্রয়োজনে তা প্রয়োগ করা বিশেষ জরুরী। ব্যাপারির সবসময় দৃষ্টি থাকে কখন পুরানো মালটি আগে বিক্রয় করা যায় কিন্তু ক্রেতা যদি সজাগ হয় তবে কখনও সে পচা কিংবা পুরানো জিনিস বিক্রয় করতে পারবে না। মনে রাখবেন, লোকাল ট্যাক্স উঠে গেছে। বিশেষ কয়েকটি ঔষধ ছাড়া সাধারণত দামের অতিরিক্ত টাকা আজকাল আর লোকাল ট্যাক্স-এর নাম করে সংগ্রহ করা যায় না। এখন দাম লেখা থাকে সবশুদ্ধ যোগ করে। অর্থাৎ লিখিত দামের এক পয়সাও বেশী দেবেন না। রসিদ নিতেই হবে। যদি দোকানদার রসিদ দিতে অস্বীকার করে তবে বুঝতে হবে দ্রব্যটি সঠিক নয়। সকল খরিদ্দার যদি একই সাথে রসিদ চাওয়ার অভ্যাস করেন তবে বিক্রেতারও রসিদ দেওয়ার অভ্যাস হবে। ম্যানুফ্যাকচারের তারিখ, লাইসেন্স নম্বর, সময়সীমা শেষ হওয়ার তারিখ প্রভৃতি দেখে নিতে হবে। বিক্রিত দ্রব্যের সকল খবরাখবর নেওয়াকেই ক্রেতা সুরক্ষায় প্রদত্ত খবরাখবরের অধিকার বলা হয়। যে-কোন প্যাকেট করা জিনিষের গায়ে কী কী জিনিস মিশ্রিত করা আছে সেইসব তথ্য দেওয়া বাধ্যতা মূলক আইন। ক্রেতা সুরক্ষায় যে শিক্ষণীয় বিষয় আছে তা শুধু পুঁথিগত বিদ্যা নয়। দৈনন্দিন জীবনে সুস্থভাবে বেঁচে থাকবার শিক্ষা। এখানে স্কুল-কলেজের ছাপ মারা কোনো ডিগ্রি দেওয়া হয় না। জীবন যুদ্ধে লড়াই করে জিততে হবে। কীভাবে রণসজ্জায় সজ্জিত হলে তা সম্ভব সেই শিক্ষাই দেওয়া হয়। চোখ কান খোলা রেখে কেনাকাটা করতে হবে। ওজন ও দাঁড়িপাল্লা ঠিক আছে কিনা দেখে নিতে হবে। কাঁটা দাঁড়িপাল্লাই সঠিক মাপকাঠি। বাঁশের দাঁড়িপাল্লা বে-আইনী। বাটখারা নবীকরণ হয়েছে কিনা পরীক্ষা করা দরকার। উল্টোদিকে ছাপ এবং তারিখ দেওয়া থাকে। ওই ছাপটি ছাড়া ওজনের সঠিক মাপ দেখে নেওয়ার কোন পদ্ধতি নেই। সাধারণত: ওজন ও মাপ কম দেওয়া ঠকাবার একটি বিশেষ পদ্ধতি। অসৎ ব্যবসায়ীরা ওজন ও মাপে ঠকিয়ে মোটা লাভ করেন। এই বিষয়টিতে ক্রেতাদের বিশেষ নজর দেওয়া দরকার। এই সকল বিষয় নানাবিধ সম্যক জ্ঞানই শিক্ষার অধিকার বলে চিহ্নিত আছে। সভা, সেমিনার, আলোচনা চক্র প্রভৃতির মাধ্যমে নানাবিধ উপায়ে ভাবের আদান প্রদান বিশেষ জরুরী ক্রেতা সুরক্ষা আন্দোলন সফল হচ্ছে। এর প্রমাণ স্বরূপ বলা চলে, বিভিন্ন সরকারী সংস্থাতেও ক্রেতা সংগঠনগুলির প্রতিনিধিত্ব বেড়েছে। অতীতে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে বাৎসরিক বাজেট স্থির করা হত। ক্রেতা সংগঠনকে পরামর্শ করা হত না। গত পাঁচ-সাত বছর যাবৎ অগ্রণী ক্রেতা সংগঠনদের পরামর্শ করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রক বাজেটের আগে মিটিং আহ্বান করে। স্বয়ং অর্থমন্ত্রী চেয়ারম্যান। টেলিফোন, রেল, এল. পি. জি. প্রভৃতি অত্যন্ত জরুরী পরিষেবামূলক সরকারী সংস্থায় ক্রেতা প্রতিনিধিত্ব আছে। এছাড়া ভারত সরকারের সর্বোচ্চ পরিষদ সেন্ট্রাল কাউন্সিল আছে সেখানে সকল অগ্রণী ক্রেতা সংস্থা সদস্য। প্রতি রাজ্যেও রাজ্য পরিষদ আছে। রাজ্যের বিশিষ্ট ক্রেতা সংগঠনগুলি এর সদস্য। সুতরাং ক্রেতা সুরক্ষা আইনে প্রতিনিধিত্বের সে অধিকার দেওয়া আছে তা সু-প্রতিষ্ঠিত। এবার শেষ অধিকারটির কথা বলি অর্থাৎ প্রতিকারের অধিকার। উপরের যে পাঁচটি অধিকারের কথা বলা হয়েছে সেই সকল অধিকার যদি ঠিক ঠিক পালন করা হয় তবে তো সোনার সংসার। কিন্তু বাস্তব বড় কঠিন। সব অধিকার ঠিকমত সুরক্ষিত হয় না। আমরা জানি যখন কোনো অধিকার লঙ্ঘন করা হয় কিংবা বিঘ্নিত হয় তখনই আইন কানুন, দলিল, দরখাস্ত প্রভৃতি দরকার হয়। যদি এই সকল অধিকার কোন অংশে খর্ব হয় তখনই তার প্রতিকারের জন্য যে আধা বিচারবিভাগীয় ব্যবস্থা করা হয়েছে তাকেই ক্রেতা সুরক্ষা আইন বলা হয়। এটি একটি আধা বিচার বিভাগীয় আইনি ব্যবস্থা। কিছুটা জুরীর বিচারের মতন। তবে ক্রেতা সুরক্ষা আইনের তুলনা নেই। সারা বিশ্বে এর সমপর্যায়ে আধা বিচার বিভাগীয় আইন প্রায় নেই বললেই চলে। এখানে স্ট্যাম্প ফি লাগে না। উকিল না দিলেও চলে, কারণ আইনের কচকচালি থেকে কাগজপত্র সহ প্রমাণ দিলেই এর বিচার করা সম্ভব। ক্রেতারা যদি এই ছয়টি অধিকার ঠিকঠাক প্রয়োগ করতে পারেন তবে শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ সমস্যার সমাধান নিজেরাই করে ফেলা যায়। তবে যখনই আমরা ক্রেতা অধিকারের কথা বলি সাথে সাথে ক্রেতার কর্তব্যের কথাও উল্লেখ করতে হবে। সবশেষে বলি ক্রেতারা কিন্তু নিজেদের অধিকার এবং কর্তব্যের সম্বন্ধে খুব বেশী সজাগ নন। কোনো একটি সমাধানের পথ সুগম করতে ক্রেতা ও বিক্রেতা দুইপক্ষেরই সমান ভূমিকা আছে।