হাওড়া জেলার প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী দুর্গোৎসব, জানুন বিস্তারিত ইতিহাস

By নিজস্ব সংবাদদাতা

Published on:

পৃথ্বীশরাজ কুন্তী : বাংলা তথা বাঙালির প্রধান উৎসব দুর্গাপুজো। ভারতবর্ষ ও পৃথিবীর প্রাচীন রাষ্ট্রগুলিতে দেবীপুজোর চল থাকলেও উৎসব হিসাবে দুর্গাপুজোর প্রবর্তন, প্রসার এবং ব্যাপ্তি ঘটেছে এই বাংলার মাটি থেকেই। বাংলায় ঠিক কে এই পুজোর প্রচলন করেছিলেন তা নিয়ে বহু বিতর্ক রয়েছে। যুগের সাথে পাল্লা দিয়ে স্বাদ বদলাচ্ছে মানুষের ভাবনার ও সংস্কৃতির। ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে পিছনে ফেলে মানুষ মেতে উঠছে আধুনিকতার ছোঁয়ায় বর্ণময় থিম পুজোয়। আড়ম্বরপূর্ণ থিম পুজোর এই হিড়িকেও আজও বাংলার বনেদী পরিবার, জমিদারবাড়ি কিমবা রাজ পরিবার পরিচালিত দুর্গাপুজোগুলি শতাব্দীপ্রাচীন সংস্কৃতির ধারক ও বাহকরূপে আমাদের হৃদয়ে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। তাই হাওড়া জেলার বাসিন্দা হিসাবে নিজের কলমের মাধ্যমে জেলার প্রাচীন ও ঐতিহ্যমন্ডিত দুর্গোৎসব গুলিকে জনসমক্ষে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।

★গ্রামীণ হাওড়ার প্রাচীন দুর্গোৎসব সমূহ :-

১) আমতা-১ ব্লকের উদংয়ের ‘ধাড়া’ বাড়ির দুর্গোৎসবের কথায় আসি। বর্তমান প্রজন্মের মতে, এই পুজোর বয়স প্রায় ২০০-২৫০ বছর। রামবল্লভ ধাড়ার হাত ধরে এই প্রাচীন জমিদার বংশের পুজো শুরু হয়। পূর্বে পুজোর সূচনা হতো কামান দেগে। পূর্বের রীতি অনুযায়ী এখনো প্রতিবছর মহালয়া থেকে ঠাকুরদালানে চন্ডীপাঠ হয়।

২) বিংশ শতকের সূচনা লগ্ন। তখনও সমাজে নারীরা নিজ অধিকার থেকে বহুলাংশে বঞ্চিত। সেই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে হাওড়ার আমতা-২ ব্লকের জয়পুরের কাঁকরোল গ্রামের বালিয়াল পরিবারের দুর্গাপুজোর সূচনা ঘটে ঐ বংশেরই এলোকেশী দেবী নামক জনৈকা মহিলার হাত ধরে। বালিয়াল পরিবারের উঠোন লাগোয়া অধিষ্ঠিত রয়েছেন দেবী চন্ডী। প্রায় ৩০০ বছরের পুরানো এই চন্ডীতলা। পুজো ক’দিন মহামায়ার আরাধনার পাশাপাশি ‘জয়চন্ডী’ দেবীকে কেন্দ্র করেও বিভিন্ন উৎসব, অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

৩) আমতা-২ ব্লকের নারিটের ভট্টাচার্য পরিবারের মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য ছিলেন ভারতবিশ্রুত সংস্কৃত পন্ডিত ও তাঁর সুযোগ্য পুত্র মন্মথনাথ ভট্টাচার্য ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের খুব কাছের বন্ধু। এই ভট্টাচার্য পরিবার পরিচালিত দুর্গোৎসবের বয়স প্রায় ৪০০ বছর। তাঁর বাড়ির পুজো ‘ছোটো’ বাড়ির পুজো নামে খ্যাত। পক্ষান্তরে, ‘ন্যায়রত্ন’ পরিবারের ‘বড়ো’ বাড়ির পুজোও প্রায় চারশো বছরের প্রাচীন। কবি নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য ছিলেন ‘বড়ো’ বাড়ির প্রতিনিধি। কথিত আছে, বিদ্যাসাগর,শরৎচন্দ্রের ন্যায় বরেণ্য ব্যক্তিত্বরা এই দু’ই বাড়ির পুজো দেখতে এসেছিলেন।

৪) এবার আসি বাংলার অন্যতম প্রাচীন বাগনান-২ ব্লকের চন্দ্রভাগের চট্টোপাধ্যায় বাড়ির পুজো। প্রায় ৭০০ বছরের প্রাচীন দুর্গোৎসবের সূচনা হয় ছকুরাম চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে। বংশধররা তাঁদের এই পুজোকে বাংলার প্রাচীনতম বাড়ির দুর্গোৎসব হিসেবে দাবি করেন। মহালয়ার পরেরদিনই মা চন্ডীর বোধন হয় বহু প্রাচীন এই পুজোয়।

৫) সালটা ১৯৩৪। গ্রামীণ হাওড়ার পাঁচলার বেলকুলাইয়ের দাস পরিবারের সদস্যা কাদম্বিনী দেবী মা দুর্গার আরাধনার স্বপ্নাদেশ পেলেন। তাঁর দুই পুত্র চন্দ্রকুমার দাস ও অধরচন্দ্র দাসের উদ্যোগে ঐবছরই মহালয়ায় হল মায়ের বোধন। এই পুজোয় দেবীর মৃন্ময়ী মূর্তির পাশেই পূজিতা হন পারিবারিক ‘ধনলক্ষ্মী’, যা এই পুজোর অন্যতম বিশেষত্ব।

৬) উদয়নারায়ণপুর ব্লকের হরিশপুরের পাত্রবাড়ির পুজো প্রায় ২৬০ বছরের প্রাচীন। এখানে দেবী ‘অভয়াচন্ডী’ রূপে পূজিতা হন। পাত্রবাড়ির পুজোয় মহাষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত মোট ১২ মন চাল নিবেদন করা হয়। পাত্রবাড়ির পুজোয় মহাষ্টমী, নবমী এবং সন্ধিপুজোয় মোট তিনটি পাঁঠাবলি হয়।

৭) উদয়নারায়ণপুর ব্লকের জয়নগরের দলপতিচকের মন্ডল পরিবারের পুজো প্রায় ৩০০ বছরের প্রাচীন। শোনা যায়, বর্ধমান রাজার মা কর্তৃক প্রদত্ত পেতলমূর্তি দেবীরূপে পূজিতা হন এখানে। নবমী তিথিতে পাঁঠাবলি, সব্জিবলি ও ফলবলি প্রথার প্রচলন আছে এই সুপ্রাচীন পুজোয়।

৮) আমতার জয়ন্তী গ্রামের লাহা পরিবারের দুর্গাপুজো প্রায় ৩৫০ বছরের পুরানো।

৯) ফুলেশ্বরের চক্রবর্তী পরিবারের পুজোর বয়স প্রায় ২০০ বছর।

১০) আমতা-২ ব্লকের ভাটোরার মুখার্জী বাড়ির পুজো।

১১) পেঁড়োয় প্রখ্যাত কবি রায়গুণকার ভারতচন্দ্রের পরিবার পরিচালিত দুর্গোৎসব প্রায় ৩০০ বছরের প্রাচীন। জন্মাষ্ঠমী তিথিতে এখানে নারায়ণের মাথায় ১০৮ কলসি জল ঢালার অনুষ্ঠান হয়। নারায়ণের মাথায় জল ঢালার ফলে সেই জল মাটিতে পড়ে মাটি ভিজে নরম কাদায় পরিণত হয়। সেই মাটি দিয়ে দুর্গাপ্রতিমা তৈরির সূচনা হয়। পেঁড়োয় ‘রণ’ নদী রয়েছে। এই নদীর পাড়ে রানি ভবশঙ্করীর সঙ্গে পাঠানদের যুদ্ধ হয়েছিল শোনা যায়।বাল্যকালে এই পুজোয় কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর নিজে পুষ্পাঞ্জলি দিতেন বলে জানা যায়। রায় বাড়িতে অষ্টধাতুর তৈরি মূর্তি ‘জয় দুর্গা’ রূপে সারাবছর পূজিত হন।

১২) অমরাগড়ীর গজলক্ষীমাতা এস্টেট পরিচালিত রায় বাড়ির দুর্গোৎসব এবছর দুর্গোৎসব ৩০১ বছরে পদার্পণ করল। ১১২৬ বঙ্গাব্দে শান্তি রায় এই পুজোর সূচনা করেন। রায় বাড়িতে প্রাথমিক লগ্ন থেকে একচালায় নির্মিত চামূন্ডা মূর্তি মহামায়া রূপে পূজিতা হন। মহালয়ার পরদিন অর্থাৎ প্রতিপদ থেকেই এই বনেদী বাড়ির পুজোয় ঢাকে কাঠি পরে যায়। শুরু হয় চণ্ডীপাঠ, সান্ধ্যকালীন নিত্য আরতি। বাড়ির মেয়েরা ব্যস্ত হয়ে পরেন নাড়ু পাকানোর কাজে। দুর্গাদালানে কচিকাচাদের ভিড় জমতে শুরু করে। বহু ইতিহাসের সাক্ষ্যবহনকারী এই বাড়ির অন্দরমহলে কান পাতলে কিমবা এস্টেটের ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে দুর্গাপুজো সম্পর্কে অনেক অজানা চমকপ্রদ তথ্যই উঠে আসে। পরিবার সূত্রে জানা যায়, পূর্বে মোষবলির প্রচলন থাকলেও তা বহু বছর আগেই বন্ধ হয়েছে। এর পিছনেও রয়েছে এক বিস্ময়কর কাহিনী। শোনা যায়, প্রায় দু’শো বছর আগে এক কামার এই বাড়ির সন্ধিপুজোর জন্য বাড়ি থেকে রওনা দিয়েছিল। রাস্তায় বাঘের খপ্পরে পরলে সেই কামার বাঘের মুন্ডুচ্ছেদ করে। তারপর থেকে দেবীর স্বপ্নাদেশেই চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় মোষবলি প্রথা। মোষবলির এই প্রাচীন প্রথা বন্ধ হলেও চিরাচরিত প্রথা অনুসারেই আজও নবমীর সন্ধ্যায় আগত দর্শনার্থীদের মধ্যে লুচি ভোগ বিতরণ করা হয়। বিজয় দশমীতে বরুণ দেব যখন মধ্যগগনে আসীন তখন ভারাক্রান্ত হৃদয়ে পারিবারিক রথপুকুরে বিসর্জনের পথে এগিয়ে চলেন এই ঐতিহ্যসমৃদ্ধ পরিবারের মৃন্ময়ী মা। রায় বাড়ি সূত্রে জানা যায়, প্রায় দেড়শ বছর আগে পরিবারের এক সদস্য দুপুর ১২ টায় মারা যাওয়ার পর থেকেই দেবীর নিরঞ্জন প্রক্রিয়া ঠিক দুপুর ১২ টায় সম্পন্ন হয়।

১৩) উদয়নারায়ণপুর ব্লকের কানপুরের পালচৌধুরী বাড়ির পূজা ও এই ব্লকের ব্যানার্জী জমিদার বাড়ির ২৫০-৩০০ বছরের প্রাচীন পুজোও বিশেষভাবে উল্লেখ্য।

১৪) আমতা-২ নং ব্লকের তাজপুর গ্রামের রায় পরিবার পরিচালিত দুর্গোৎসব প্রায় ২০০ বছরের প্রাচীন। তাজপুরেরই ভট্টাচার্য বাড়ির পুজোও প্রায় সমসাময়িক। মূলত বর্ধমান রাজার উৎসাহেই প্রজাদের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যেই উভয় বাড়ির পুজো শুরু হয়। বিজয় দশমীতে ‘গুরু-শীষ্য’-এর সম্পর্ক রক্ষার্থে আজও এক বাড়ির প্রতিমা অন্য বাড়িতে যান।

১৫) আমতা-১ নং ব্লকের রসপুরের সাতঘরের পুজোর বয়স প্রায় ৪০০।

১৬) খড়িয়পের বোস বংশ অন্যতম বনেদী পরিবার। উল্লেখ্য, এই পরিবারেই বিয়ে হয়েছিল স্বামী বিবেকানন্দের দিদি হারামণি দেবীর। এই বনেদী বাড়ির পুজোর বয়স কমপক্ষে ৩০০ বছর।

১৭) বাগনান-১ নং ব্লকের পূর্ণাল মিলন মন্দিরের পুজো। যদিও এটি প্রাচীনত্বের দিক থেকে শতবর্ষ (বর্তমান বয়স ৮৮) অতিক্রম করেনি, কিন্তু সাবেকিয়ানার দিক থেকে এই পুজো অত্যন্ত জনপ্রিয়। বর্তমানে আমতা-বাগনান রোডের ধারে হলেও শোনা যায় পূর্বে এই পুজো হতো পূর্ণাল গ্রামের ভিতরে। প্রবল ঝড়ে মহামায়ার মৃন্ময়ী মূর্তি এসে পড়ে বর্তমান পুজো প্রাঙ্গনে। তারপর থেকে এখানেই পূজিতা হন মা।

১৮) সাঁকরাইলের রাজগঞ্জের গঙ্গারধারে পাল পরিবারের প্রায় ২৮০ বছরের প্রাচীন দুর্গাপূজা অন্যতম প্রাচীন পুজোরূপে সুবিদিত। এই পরিবারের ‘এন.সি পাল ব্রিকস’ বিশেষ খ্যাত ছিল।

১৯) পাঁতিহালের বনেদী ‘রায়’ পরিবারের দুর্গোৎসবও অন্যতম প্রাচীন পুজো হিসাবে বিবেচিত হয়। রায় পরিবারের সদস্যদের দাবি, তাঁদের পুজোর বয়স অন্তত ৬০০ বছর। বনমালী রায়ের হাত ধরে সম্ভবত এই পুজোর শুরু। রায় পরিবারের দুর্গাপ্রতিমার বৈশিষ্ট্য হল তিনি চতুর্ভূজা। দেবীপক্ষের সূচনা থেকে শুরু হয় পুজো মণ্ডপে চণ্ডীপাঠ। তা চলে টানা ১১ দিন। এই প্রথা চলে আসছে ৬০০ বছর আগে থেকে।

২০) অকাল বোধনের রীতি মেনেই দেবীর সন্ধিপুজোয় ১০৮টি পদ্ম নিবেদেনের রেওয়াজ। মনোবাঞ্ছা পূরণে ১০৮টি পদ্ম নিবেদন করা হয়। কিন্তু, হাওড়ার আমতার হরিশপুর গ্রামের ৭৬ বছরের এক পুজোয় এখনও নীলপদ্ম চাই-ই চাই। নীলপদ্ম না হলে হবে না দেবীর সন্ধিপুজোই।

২১) উদয়নারায়ণপুরের শিবপুরের গাঙ্গুলিবাড়ির পুজো অতি প্রাচীন বলে জানা যায়। ১১০০ বঙ্গাব্দে চন্দ্রশেখর গঙ্গোপাধ্যায়ের হাত ধরে এই পুজো শুরু হয়। মহাষষ্ঠীর দিন কল্পারম্ভ অনুষ্ঠান হয়। সপ্তমীতে সন্ধিপুজো, নবমীতে পাঁঠাবলি হয়। দশমীর দিন শাঁখাপরানি গান গেয়ে সাপুড়েরা এসে বাড়ির সধবা মহিলাদের শাঁখা পরিয়ে যায়। লুপ্তপ্রায় লোকগান — হরপার্বতীর গুণকীর্তন এবং মহিমা বাংলার কবিয়ালরা যা গাইতেন, তা আজও গাঙ্গুলিবাড়ির পুজোয় শোনা যায়।

২২) উদয়নারায়ণপুর ব্লকের কুরচির পালবাড়ির পুজোও প্রায় ৩০০ বছরের প্রাচীন বলে জানা যায়। পালবাড়ির নাটমন্দিরে নারায়ণের মূর্তি থাকায় এই পুজোয় বলির প্রথা নেই। মা’কে এখানে ১০৮টি রমনী (রঙ্গন) ফুলের মালা পরিয়ে পুজো করা হয়। এই পুজোতেও দশমীর দিন শাঁখাপরানি গান গেয়ে সাঁপুড়েরা এয়োস্ত্রীদের শাঁখা পরিয়ে যায়।

২৩) উদয়নারায়ণপুর ব্লকের সোনাতলা মিলন সংঘ এক সময় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আখড়া ছিল। তবে এখন আর সোনাতলা মিলন সংঘ নয় শুধুই সোনাতলা সার্বজনীন দুর্গোৎসব নাম হয়েছে। তরুণদের লাঠি খেলা থেকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামী এখানে এসে আত্মগোপন করে থাকতেন। এই পুজোর প্রথম ঘটস্থাপন করেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামীরা। তাই এটি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের তৈরি পুজো বলেই পরিচিত। এই পুজোর বয়স প্রায় ৮৬।

২৪) মা সারদাই দুর্গারূপে পূজিতা হন আমতার শ্রীরামকৃষ্ণ প্রেমবিহার আশ্রমে। ১৯৯৯ সালে শুরু হওয়া এই ঐতিহ্যবাহী পুজোয় দেবীর বিসর্জন নেই, হয় কেবল ঘর বদল।দশমীতে মা সারদা আশ্রম মন্দিরে ফিরে যান শ্রী রামকৃষ্ণদেবের পাশে।

২৫) আমতার নারিট গ্রামের সিংহমজুমদার বাড়ির দ্বিশতবর্ষ প্রাচীন পুজো আজও প্রচলিত মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের দান করা জায়দাদনামার ঐতিহাসিক পুজো হিসেবে। চিরাচরিত রীতি মেনে গাজি পিরের দরগায় শিরনি দিয়ে সূচনা হয় এই দুর্গোৎসবের। হাওড়ার নারিট-গাজিপুরের সিংহমজুমদার বাড়ির মাতৃ আরাধনায় সন্ধিপুজো আর কুমারীপুজো হয়ে ওঠে আক্ষরিক অর্থেই একটা মহোৎসব। দশমীতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মহিলারা মেতে ওঠেন সিঁদুর খেলায়।

২৬) বাগনান-১ ব্লকের বাগনান রথতলার নন্দীবাড়ির পুজো অন্যতম। এখানে সন্ধিপুজোর আগে ফায়ারিং করা হয়।

২৭) ভবানীপুরের চন্দ্রবাড়ির দুর্গোৎসব বিশেষভাবে উল্লেখ্য।

★সদর হাওড়ার প্রাচীন দুর্গোৎসব সমূহ :-

১) সদর হাওড়ার দুর্গোৎসব প্রসঙ্গে বলতে হলে সর্বপ্রথমই আসে ‘আন্দুল রাজবাড়ী’-র পুজোর কথা। জেলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও প্রাচীন দুর্গোৎসব। ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে জমিদার রামলোচন রায় ইংরেজ বড়োলাট ক্লাইভের পরামর্শে এই পূজার সূচনা করেন। জানা যায় যে, প্রথমবর্ষের পুজোয় উপস্থিত ছিলেন লর্ড ক্লাইভ স্বয়ং। তিনি দেবীর পাদপদ্মে ১০৮ টি পদ্ম ও ১ হাজার টাকা প্রণামী নিবেদন করেন।

২) আন্দুলের দত্তচৌধুরী বাড়ির পুজোও প্রায় কয়েকশো বছরের প্রাচীন। বনেদীয়ানা হ্রাসের সাথে সাথে পূজাপার্বনের রীতিনীতিতেও আজকাল ভাটা পড়েছে প্রাচীন পুজোগুলিতে। কিন্ত, এদিক থেকে এই বংশের পুজো আজও তার ঐতিহ্য ও রীতিনীতিকে বহন করে চলেছে সমানভাবে। বর্তমানে চালগুঁড়িতে নির্মিত কলাগাছের খোলে ‘শত্রুমূর্তি’ বলি দেওয়া হয়। এখানে পুজো হয় ‘বৃহন্নন্দিকেশ্বর পুরাণ’ মতে৷ বোধন হয় পুজোর ঠিক ১২ দিন আগে অর্থাৎ কৃষ্ণনবমী তিথিতে আর শেষ হয় দুর্গানবমী তিথিতে ৷ পুজো বোধনকালে পরিবারের অবিবাহিতা মেয়েরা হাতে শাঁখা পরেন ৷

৩) এরপরেই এসে যায় বেলুড় মঠের দুর্গাপূজার কথা। বাংলা তথা ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অগণিত মানুষ ছুটে আসেন যুগপুরুষ স্বামী বিবেকানন্দ প্রবর্তিত এই দুর্গাপূজায় যোগদানের উদ্দেশ্যে। এইপূজার অন্যতম বৈশিষ্ট্য তথা আকর্ষণ অষ্টমীতিথিতে ‘কুমারী পূজা’। স্বামীজি মানুষের মধ্যেই খুঁজে পেয়েছিলেন পরম ঈশ্বরকে। তাই তিনি ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা’র সাথে সাথে সমাজের মাতৃরূপা নারীশক্তির আরাধনা করতে ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে প্রথম কুমারী পূজা চালু করেছিলেন। প্রসঙ্গক্রমে জানিয়ে রাখি, স্বামীজি সর্বপ্রথম ‘কুমারী’ হিসাবে পূজা করেছিলেন তাঁর প্রিয় বন্ধু তথা আমতার ভূমিপুত্র মন্মথনাথ ভট্টাচার্যের কন্যাকে। যদিও এটি বেলুড়ে না মাদ্রাজে সেটা নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন রয়ে গেছে।

৪) আন্দুলের কুন্ডু চৌধুরী বাড়ির পুজো জেলার অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী দুর্গোৎসব হিসাবে বিবেচিত হয়। তৎকালীন সময়ে জমিদার ও ব্যাবসায়ীদের অন্যতম ব্যবহার্য উপাদান ছিল ‘নৌকা’। মৃন্ময়ী মূর্তির আরাধনার সাথে ‘নৌকা’-কে পুজো করা হত। এই রীতি আজও স্বমহিমায় অটুট রয়েছে।

৫) দেশজুড়ে স্বদেশী আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বাংলা তখন জাতীয়তাবাদের সূতিকাগার। সেই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে হাওড়ার কিছু যুবক স্থানীয় ছাত্র-যুবকে স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে গড়ে তুললেন ‘হাওড়া সেবা সংঘ’। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর পরামর্শ অনুযায়ী বাগবাজার সর্বজনীনের পুজোয় প্রাণিত হয়ে হরেন্দ্র নাথ ঘোষ সংঘের সদস্যদের নিয়ে ১৯২৭ সালে চালু করলেন জেলার অন্যতম প্রাচীন সর্বজনীন দুর্গোৎসব। স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত থাকার কারণে ব্রিটিশ সরকার ১৯৪২-৪৪ সালে এই সংস্থাকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করে। যার ফলে ওই তিনবছর পুজো বন্ধ থাকে।শতবর্ষের দ্বারে উপনীত এই পুজোয় নবমী তিথিতে দু’ঘন্টা ধরে মহারতি অনুষ্ঠিত হয় যা এই প্রাচীন পুজোর অন্যতম মূল আকর্ষণ। উল্লেখ্য, কদমতলার এই দুর্গোৎসব জেলার প্রাচীনতম সর্বজনীন দুর্গোৎসব।

৬) ১৬৮৫ খ্রিস্টাব্দে শিবপুরের রায়চৌধুরী বাড়ির পুজো শুরু হয় রাজা রামব্রহ্ম রায়চৌধুরীর হাত ধরে। এই পরিবারের কুলদেবতা হলেন ‘ব্যাতাইচন্ডী’। ব্যাতাইচন্ডীর মুকুট খুলে এনে মা দুর্গার মাথায় পরানো হয়।

৭) হাওড়া সদরের প্রাচীন পুজোগুলির মধ্যে শিবপুরের ভট্টাচার্য পরিবারের পুজো অন্যতম। শিবপুরের প্রাচীন জমিদার রায়চৌধুরী বংশের প্রতিষ্ঠাতা রাজা রামব্রহ্ম। তিনি শিবপুর, সলপ, নিবড়া, বাঁকড়া, বেতড়ের ন্যায় পৈতৃক জমিদারির তেরোটি গ্রাম নিজের ভাগে পেয়ে শিবপুরে বসতি স্থাপন করেন। রায়চৌধুরী বংশের পূজারি ছিলেন এই ভট্টাচার্য পরিবারের পুরোহিতরা। তাঁরা রায়চৌধুরীদের সাথে একই সময়ে শিবপুরে বসতি স্থাপন করেন। ভট্টাচার্য বাড়ি সংলগ্ন ঠাকুরঘরে প্রতিবছর এই প্রাচীন দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়।

৮) সালকিয়ার ‘আটা’ পরিবারের পুজো প্রায় ২০০ বছরের প্রাচীন। লোহা ব্যবসায়ী নফরচন্দ্র আটার হাত ধরে এই পুজোর সূচনা হয়েছিল।

৯) সালকিয়ার বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির পুজোও জেলার অন্যতম প্রাচীন।

১০) বালির ব্যানার্জী বাড়ির দুর্গোৎসব। এই পুজোয় বিশ্বের পবিত্র নদীগুলির জল ব্যবহৃত হয়।

১১) শিবপুরের বি.কে পাল বাড়ির পুজো প্রায় ৩০০ বছরের প্রাচীন। মহানবমীতে এই পুজোয় মোষবলির প্রচলন আছে।

১২) সালকিয়ার ঘোষ বাড়ির পুজোর সূচনা ঘটেছিল ১৮০১ সালে। মাত্র ১৪ বছর বয়সে মাধবচন্দ্র ঘোষ নামে জনৈক যুবক এই পুজোর প্রচলন করেন।

১৩) আন্দুলের ভট্টাচার্য বাড়ির দুর্গোৎসবও বহুপ্রাচীন।১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে এই পূজার সূচনা ঘটে।

১৪) প্রখ্যাত গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৈতৃক বাড়ির পুজো প্রায় ৩০০ বছরের প্রাচীন। এই বনেদী পরিবারের পুজো শুরু হয়েছিল জমিদার রাধামোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে। পুলক বাবুর হাত ধরে সালকিয়ার প্রাচীন এই দুর্গোৎসব এক অনন্য মাত্রায় পৌঁছায়। পুজোয় বসত গানের আসর। মান্না দে, উত্তম কুমারের ন্যায় সংস্কৃতি জগতের প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্বরা আসতেন পুজোয় আসর জমাতে। প্রতিমা নিরঞ্জনের আগে ছাচি কুমড়ো, পান্তা ভাত, মুসুর ডাল, ল্যাটা মাছ পোড়া ভোগ দেওয়া হয় মায়ের কাছে যা এই পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

কালের অমোঘ নিয়মে বিস্মৃতির অতল গভীরে আজ হারিয়ে গেছে অনেক কিছুই। আজ হয়তো নেই রাজতন্ত্র কিমবা জমিদারীপ্রথা। আজ হয়তো হারিয়ে গেছে সেইসব সংস্কৃতি – ঐতিহ্য – রীতিনীতি – সাবেকী। বাংলার বুকে ছড়িয়ে আছে কত বনেদি বাড়ির ইতিহাস। কোথাও রাজবাড়ির পুজো, আবার কোথাও জমিদার বাড়ির পুজো। পুরনো সেই সব বাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহু জনশ্রুতি, গল্পগাথা। সময়ের সাথে সাথে বনেদি বাড়ির পুজোর জৌলুস কমলেও, সাবেকিয়ানা এখনও অটুট ইতিহাসের গন্ধমাখা শতাব্দী প্রাচীন এই সব পুজোয়। তাই আজও আমরা হাজার থিমপুজোর মাঝেও হাজির হই কতশত বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যবাহী এই সমস্ত বনেদী দুর্গোৎসবগুলিতে।