পৃথ্বীশরাজ কুন্তী: নামশিলা, কুশনু, রাজেন দাঁতভাঙা নামের সাথে হাড়ভাঙা খাটুনি। ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই শুরু হয় ওদের জীবন সংগ্রাম।বাবা-মা’য়ের মতো ওরাও একমুঠো অন্ন সংস্থানের তাগিদে শুরু করে লড়াই।কারুর বয়স ৭,কারুর ১০ আবার বা ১৪। কচিকচি হাতগুলো একের পর এক ইট উল্টে যায় লাইন দিয়ে।ওরা প্রত্যেকেই মূলত ঝাড়খন্ড, বিহার ও ওডিশা থেকে কাজের তাগিদে বাংলায় আসে।প্রত্যেকেই তফশিলী উপজাতিভুক্ত।ঝাড়খণ্ড, ওডিশা বা বিহারে সেভাবে কর্ম সংস্থান না হওয়ায় এরকম বহু পরিবার চলে আসে বাংলায়।এই দরিদ্র শ্রমিকগুলো হাড়ভাঙা খাটুনির চক্রে বাঁধা।এঁদের জীবনে কাজ সেভাবে কোনও উন্নতি আনতে পারে না, বরং পরের প্রজন্মকে ফের টেনে আনে ইটভাটায়। আগামীর স্বপ্নগুলো আবদ্ধ থেকে যায় ইটভাটার প্রাচীরের চার দেওয়ালের মধ্যেই। উল্লেখ্য গ্রামীণ হাওড়ার শ্যামপুর-১ ও শ্যামপুর-২ ব্লকে হুগলী ও রূপনারায়ণ নদীর তীরে কয়েক’শো ইটভাটা অবস্থান করছে।
শিবগঞ্জ, ডিঙেখোলা, শ্যামপুরের এই সমস্ত ভাটাগুলোয় কয়েক হাজার ভিন রাজ্যের পরিবার অন্ন সংস্থানের তাগিদে আসে।প্রত্যেকটিই প্রায় বড়ো পরিবার।মা-বাবার পাশাপাশি একাধিক সন্তান।ভরপেট আহারের সংস্থান করতে গিয়ে বাবা-মা’র সাথে ইট পোড়ানোর কাজে হাত লাগায় ছোটো ছোটো শিশুরা। শিশুশ্রম সম্পর্কিত বিভিন্ন আইন থাকলেও,আইনকে দিনের পর দিন বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কুশনু, পূজাদের শৈশব হারিয়ে যাচ্ছে ইটভাটার বাবুদের চোখরাঙানির কাছে।জিতেন, শীলাদের কেউ কেউ স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিভিন্ন শ্রেণীতে ভর্তি হলেও সেই সংখ্যাটা খুব কম।আবার কেউ কেউ এখন আর বিদ্যালয়ে যায় না।বিভিন্ন উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত এই সমস্ত শিশুদের ভাষা মূলত হিন্দী ও বিভিন্ন আদিবাসী ভাষা। তাই বাংলা মাধ্যমে পরিচালিত স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেনা বাংলা সংস্কৃতির সাথে। অন্যদিকে, প্রতিবছর অক্টোবর-নভেম্বরে এসে আবার মে-জুনে সপরিবারে নিজ্যের রাজ্যে ফিরে যায় পরিবারগুলো।ফলে এইসব শিশুরা কার্যত শিক্ষা থেকে বঞ্চিতই থেকে যায়।
পাশাপাশি, ঝুপড়ির একচিলতে বাসস্থানের মধ্যে গাদাগাদি করে অনেকগুলো মানুষের বাস। এমনকি ঘরে ঠিকমতো পৌঁছায়না সূর্যের আলো। অন্ধকার নামলেই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে চলে মদ্যপান। এরকমই চূড়ান্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মাঝে বেড়ে উঠছে হাজারো শিশু।এদের লড়াইটা একমুঠো ভাতের তাগিদে।সর্দাররা বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে শ্রমিকদের সপরিবারে ইটভাটায় আসতে বাধ্য করেন। এর কারণ জানতে চাইলে নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক এক ম্যানেজার বলেন, “শ্রমিক-পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বোঝাপড়া ভালো,তাই একসঙ্গে কাজ করলে উৎপাদন হয় বেশি।” তারউপর সারাবছর জোটেনা কাজ।বর্ষার সময় দীর্ঘ প্রায় ৩-৪ মাস নিজেদের বাড়িতে ফিরে যায় পরিবারগুলি।আবার, কয়েক মাস পর পা রাখে বাংলায়। যদিও কোথায় কাজ পাবে সেটা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে ‘সর্দার’দের উপর।নিয়মিত পায়না মজুরির অর্থ।আর তার সাথে রাতের অন্ধকারে সর্দারদের চোখরাঙানি, শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার তো রয়েইছে।তবুও নির্বিকার ওরা! এভাবেই খেলামবাটি খেলা শিশুদের শৈশব হারিয়ে যায় জ্বলন্ত চুল্লির কালো ধোঁয়ায়, শিক্ষার স্বপ্ন লুপ্ত হয় সাজানো ইটের সারির অলিতে-গলিতে, ভবিষ্যৎ বন্দী থেকে যায় ইটাভাটার অতল গভীরে।তবুও ওরা লড়ে যায়, একমুঠো ‘ভাত’এর তাগিদে!