কার্গিল যুদ্ধে বাংলার নায়ক কোলকাতার লেফটেন্যান্ট কণাদ, জেনে নিন তার আত্মত্যাগের বীরগাথা

By নিজস্ব সংবাদদাতা

Updated on:

নিজস্ব সংবাদদাতা : লেফটেন্যান্ট কণাদ ভট্টাচার্য। কালের অমোঘ নিয়মে এ শতকের নতুন প্রজন্ম এই বাঙালি নামের সাথে সেভাবে পরিচিত না হলেও বিংশ শতকের অন্তিম লগ্নে কেবল বাঙালি নয় কয়েক কোটি দেশবাসী চিনেছে কোলকাতার কণাদকে। সৌজন্যে কণাদের বীরত্ব, অকুতোভয় লড়াই, হার না মানা মানসিকতা ও সর্বোপরি দেশমাতৃকার জন্য মাত্র ২৪ বছর বয়সে তাঁর আত্মত্যাগ। আয়কর বিভাগের উচ্চপদস্থ আধিকারিক কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের দু’ই মেয়ে ও একছেলে। বাবা কর্মসূত্রে বাইরে থাকায় ছোটোথেকেই কণাদ ও তাঁর দিদিরা 3/2 D, BT রোডে মামার বাড়িতেই মানুষ। কণাদ তথা আদরের ‘বাবু’ ছোটো থেকেই ক্রিকেটের ভক্ত ছিল। খেলতও খুব ভালো।

এমনকি সুবার্বন ক্লাবের হয়ে সিএবি লিগে ফার্স্ট ডিভিশনও খেলেছেন টালার বাসিন্দা বাবু। বিপদে-আপদে ঝাঁপিয়ে পড়া ছিল তাঁর অভ্যাস। ছ’ফুট উচ্চতা আর ছিপছিপে চেহারার কণাদ ছোটো থেকেই সেনা বাহিনীতে যোগ দেওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। তাঁর স্বপ্ন একদিন বাস্তবে রূপায়িত হল। সেন্ট জেমস স্কুলের এই প্রাক্তনী যোগ দিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৮ নং শিখ রেজিমেন্টে। সার্ভিস নাম্বার ছিল এসএস-৩৭৮১৮। সেনা বাহিনীতে যোগ দেওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই কার্গিল যুদ্ধের সূচনা ঘটে। ‘অপারেশন বিজয়’-এ সাফল্য পেতে সদ্য যোগ দেওয়া লেফটেন্যান্ট কণাদের ইউনিটকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল কার্গিলের রণাঙ্গনে।

ইতিমধ্যেই কার্গিলের বিভিন্ন পাহাড়ের চূড়া দখল করে নিয়েছে পাক অনুপ্রবেশকারীরা। বাঙ্কার তৈরি, ঘাঁটি গড়ে তোলার কাজও অনেকটাই এগিয়ে ফেলেছে। পাহাড়ের চূড়া দখল করে ফেলায় অনেকটাই এডভান্টেজ পজিশনে ছিল পাক হানাদাররা। তবে ভারতমাতার বীর যোদ্ধারাও সহজে ছাড়ার পাত্র নন। কোলকাতার কণাদের বাহিনীর উপর টাইগার হিলে অপারেশন চালানো ও তা দখলের দায়িত্ব বর্তালো। উল্লেখ্য, টাইগার হিল দখল করাটা অত্যন্ত কঠিন কাজ ছিল। টাইগার হিলকে দখল করতে গেলে অন্যান্য পাকিস্তানি পোস্ট থেকে টাইগার হিলের চূড়াকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে।

পাশাপাশি, পাকিস্তানের সমস্ত সাপ্লাই লাইন কাটতে হবে। তাই অতি সন্তর্পণে অন্য পন্থা নিল ৮ নং শিখ রেজিমেন্টের জওয়ানরা। লেফটেন্যান্ট কণাদ ভট্টাচার্য আর সিপাহী মেজর সিংয়ের নেতৃত্বে দু’দিক থেকে দু’টি দল এগোতে শুরু করেছিল টাইগার হিলের চূড়ারর দিকে। মৃত্যু অবধারিত জেনেও পাকিস্তানি সেনাদের উপর একনাগাড়ে গুলিবর্ষণ করতে করতে বীর যোদ্ধার মতো সেদিন টাইগার হিল টপের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন এই বঙ্গতনয়। তাঁর গ্রেনেডের দাপটে সেদিন পাকিস্তানি সেনাদের লাশের পর লাশ পড়েছিল টাইগার হিলের বিভিন্ন অংশে। শেষ অব্ধি আর অভীষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানো হলনা কোলকাতা টালাব্রিজের ভূমিপুত্র বাবুর। শত্রুপক্ষের গুলিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল তরতাজা প্রাণ। জীবনের শেষমুহুর্তেও রণাঙ্গনে লড়াই চালিয়ে গেছেন এই বাঙালি যুবক। টাইগার হিলের শ্বেতশুভ্র বরফ সেদিন রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছিল এক অপরাজেয় বাঙালি যোদ্ধার তাজা রক্তে।

সেনাবাহিনীর তরফে ২১ শে মে লেফটেন্যান্ট কণাদ ভট্টাচার্যকে নিখোঁজ হিসাবে ঘোষণা করা হয়। অবশেষে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বীর যোদ্ধাদের বীরত্বের কাছে পাকিস্তানি হানাদাররা পিছু হটতে বাধ্য হয়। কণাদের নিথর দেহ উদ্ধার করে সেনাবাহিনীর জওয়ানরা। তারপর কোলকাতার ‘বাবু’ সহযোদ্ধাদের কাঁধে চেপে কফিনবন্দী হয়ে শেষবারের মতো বাড়ি ফিরলেন। কার্গিল যুদ্ধের প্রথম বাঙালি শহিদ কণাদ ভট্টাচার্যকে শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানাতে সেদিন টালাব্রিজ সংলগ্ন বাড়িতে হাজির হয়েছিলেন অগণিত বাঙালি। ত্রিবর্ণ রঞ্জিত জাতীয় পতাকায় মোড়া ছেলেকে শেষবারের মতো দেখে যখন শোকাচ্ছন্ন হয়ে গেছেন পূর্ণিমা দেবী; তখন বীর যোদ্ধার বাবা সকলের উদ্দেশ্যে বারবার বলে উঠছেন, “কাঁদবেন না কেউ, ও দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে, এ মৃত্যু গর্বের।” সত্যিই কি মৃত্যু হয় লেফটেন্যান্ট কণাদ ভট্টাচার্যের মতো দেশমাতৃকার বীর সন্তানদের! ওনারা তো মৃত্যুঞ্জয়ী দেশনায়ক। ছেলের শেষকৃত্যের পর বাবা কমলাকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছিলেন দুটি লাইন, “আমার জীবনে, লভিয়া জীবনে/জাগরে সকল দেশ।”